আন্তর্জাতিক

শহিদুলের মুক্তি দাবি চার শতাধিক ভারতীয় শিল্পী-আলোকচিত্রীর

 


আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের নিঃশর্ত ও সম্মানজনক মুক্তি দাবি করেছেন ভারতের চার শতাধিক শিল্পী ও আলোকচিত্রী। তারা শহিদুল আলমের বর্তমান অবস্থা নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, আমরা ভারতীয় ফটোগ্রাফার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্পীগোষ্ঠী শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার নিয়ে চিন্তিত ও ক্ষুব্ধ। এতে তারা শহিদুল আলমকে নিজের সহকর্মী, বন্ধু ও অভিভাবক অভিহিত করে বলেন, তাকে অকারণে ও বিধিবহির্ভূতভাবে আইসিটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিবৃতিতে তারা দাবি করেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে তুলে ধরে শহিদুল আলম কোনো ভুল করেননি। এসময় তারা সড়কে অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে অনেক অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয় জানিয়ে চলমান ছাত্র আন্দোলনকে যুক্তিসঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ দাবি করেছেন। তারা বলেন, সরকারের যেকোনো পদক্ষেপের সঙ্গে একমত না হওয়া ও তার সমালোচনা করা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এ জন্য যদি শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয় তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, শহিদুল আলম তার ওপরে শারীরিক নির্যাতনের যে দাবি করেছেন তা নিয়ে ভারতীয় এই শিল্পীগোষ্ঠী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে ৪৩৮ জন স্বাক্ষর করেছেন।

বিএসএমএমইউতে  স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর  ফের ডিবিতে শহিদুল
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল আজ আদালতে জমা দেয়ার কথা থাকলেও গতকালই চিকিৎসকরা শহিদুল আলম ‘ভর্তিযোগ্য’ নন উল্লেখ করে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে দিয়েছেন। গোয়েন্দা হেফাজতে থাকার সময় নির্যাতনের অভিযোগ করে পরিবারের পক্ষ থেকে রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। নির্দেশ অনুযায়ী গতকাল সকালে গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে তাকে বিএসএমএমইউতে নেয়া হয়। তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টে তাকে ভর্তি করার মতো তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। আশঙ্কাজনক কিছু না পাওয়ায় তাকে চিকিৎসকরা ভর্তির পরামর্শ দেননি। সকাল ৯টার দিকে ড. শহিদুল আলমকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে আনা হয়। কেবিন ব্লকের ৫১২ নম্বর কক্ষে রেখে তার বেশ কিছু শারীরিক পরীক্ষা করানো হয়। তার চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের পক্ষ থেকে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি বোর্ড গঠন করা হয়। হাসপাতালের মেডিসিন অনুষদের ডিন ডা. এবি এম আব্দুল্লাহকে প্রধান করে সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান তৌহিদুল আলম, কার্ডিওলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান হারিসুল হক ও অর্থোপেডিকস বিভাগের চেয়ারম্যান আবু জাফর চৌধুরী বিরুকে বোর্ডের সদস্য রাখা হয়। বেলা সোয়া ২টার দিকে তাকে ফের ডিবি হেফাজতে পাঠানো হয়। হাসপাতাল থেকে নেয়ার সময় তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ, আইনজীবী, স্বজন ও দৃকের কয়েকজন সহকর্মী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হাসপাতালে আনা নেয়ার সময় তাকে স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে যেতে দেখা যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ আল হারুন বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আমরা চার সদস্য’র একটি বোর্ড গঠন করেছিলাম। তাদের নির্দেশনা মোতাবেক শহিদুল আলমের এক্সরে, ইসিজি, ইকো ও রক্ত পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায়  তেমন কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। তাই তাকে ভর্তিও করা হয়নি। তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেছে কিনা এমন প্রশ্নে পরিচালক বলেন, তার শরীরে আমরা কোনো আঘাতের চিহ্ন পাইনি। আমরা স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। আগামীকাল রিপোর্ট আদালতে জমা দেব। স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়ে মেডিকেল বোর্ডের প্রধান প্রফেসর ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, তার তেমন কিছুই ধরা পড়েনি। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে, এমন অভিযোগ এসেছে এর কোনো লক্ষণ পাওয়া গেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি এমন কোনো অভিযোগ করেননি।

রোববার রাতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলায় আলোকচিত্রী দৃক গ্যালারি ও পথশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ড. শহিদুল আলমকে তার ধানমন্ডির ৯/এ বাসার চার তলা থেকে নিয়ে যায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পর দিন দুপুরে তাকে আটকের তথ্য জানানো হয়। পরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। সোমবার আদালতে গাড়ি থেকে নামার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাকে আঘাত করে রক্তাক্ত করা হয়েছে। রক্তমাখা পাঞ্জাবি ধুয়ে আবার পরানো হয়েছে। আর সিএমএম আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের সময় তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। ঘুষি দিয়ে টেনেহিঁছড়ে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। দেশদ্রোহী, আইএসের এজেন্ট বলেও গালি দেয়া হয়েছে। পরে শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ শহিদুলকে ডিবি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ এনে রিমান্ডের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। রিটে বিবাদী করেন স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, উপ-মহাপরিদর্শক (ডিবি) ও রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। আবেদনে পুলিশ হেফাজতে শহিদুলকে নির্যাতন এবং চিকিৎসা না দিয়ে তাকে রিমান্ডে পাঠানোর মাধ্যমে সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৩ এবং ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আদালত তার আবেদন শুনে শহিদুল আলমকে দ্রুত ডিবি হেফাজত থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবিন ব্লক এলাকায় শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ ও তার আইনজীবীদের ঘুরাফেরা করতে দেখা যায়। সোয়া দুইটার দিকে তাকে ডিবি হেফাজতে নেয়ার সময় তার স্ত্রী ও অন্য স্বজনরা শহিদুল আলমের সঙ্গে ছিলেন। পরে তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আইনজীবীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি হাসপাতালে এসেছি। তার সঙ্গে একটু বসে কথা বলার জন্য আমি হাসপাতালের ভিসি, ডিবিকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু আমি কথা বলার সুযোগ পাইনি। আমাকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যদি আমি ডিবি অফিসে একা যাই তবে হয়তো কথা বলতে দেয়া হবে। হাসপাতালে আনার পর শহিদুল আলম তাকে কিছু বলেছিলেন কিনা এমন প্রশ্নে রেহনুমা বলেন, আমার সঙ্গে বসে কথা বলার সুযোগ হয়নি। শুধু হেঁটে হেঁটে বলেছেন আমরা কেমন আছি। তবে তিনি আদালতে অনেক কিছু বলেছেন। রেহনুমা বলেন, আদালতে আমার স্বামী বলেছেন কলিং বেলের শব্দ শুনে তিনি বাইরে এসে দেখেন কম বয়সী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশেই আরো ১৫/২০ জন যুবক। পরে তারা তার চোখ বেঁধে হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গাড়িতে করে তুলে আনে। একটি টোলে বসিয়ে ২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় তাকে বিভিন্ন কথা বলে থ্রেট করা হয়। এমনকি আমাকে তুলে নেয়া হবে বলেও তারা থ্রেট করেছে। তাকে নির্যাতন করে রক্তাক্ত করা হয়। রক্তমাখা পাঞ্জাবি ধুয়ে ইস্ত্রি করে আবার পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। আর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে দৃক গ্যালারির মহাব্যবস্থাপক এস এম রেজাউর রহমান শহিদুলের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বলেন, আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে পারি নাই। কিন্তু গাড়িতে উঠার সময়ও তিনি বলেছেন তার পায়ে ব্যথা আছে। এখন আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *