ক্রিকেট খেলা

আমেরিকার মাটিতে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ

ক্রীড়া ডেস্ক : বৃষ্টিতে ভিজল মাঠ। আনন্দে ভিজল টাইগাররা। ঢেউ উঠল গ্যালারিতে। নাচিয়ে গেল দর্শকদের। খুশিতে ভাসল দেশ। আমেরিকা জয় করল বাংলাদেশ। রচিত হলো ইতিহাস।

এ যেন এলাম, দেখলাম, জয় করলাম।

ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ক্রিকেট খেলল  বাংলাদেশ জাতীয় দল। সেন্ট কিটসে প্রথম টি টুয়েন্টিতে হেরেছিল টাইগার বাহিনী। আমেরিকায় এসে ঐতিহাসিক প্রথম জয়ে সিরিজে সমতায় ফিরেছিল তারা। শেষ ম্যাচ জিতে সিরিজ নিজেদের করে নিল। শুধু তাই নয়, পরপর দুই ম্যাচ জিতে লিখল বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন ইতিহাস। আমেরিকার মাটিতে শতভাগ সফলতার ইতিহাস। সিরিজ জয়ের ইতিহাস।

৫ আগস্ট রোববার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৮টায় শুরু হয়েছিল ম্যাচ। টসে জিতে ব্যাটিং। প্রথম থেকেই বোলারদের ওপর চড়াও বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ২০ ওভার শেষে সংগ্রহ ১৮৪। ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারেনি কখনো। ১৭.১ ওভার ৭ উইকেট ১৩৫ করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মাত্র ১৭ বল বাকি। আর তখনই বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় সব। শেষ হয়ে যায় খেলা। ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধটিতে ১৯ রানের জয় পায় বাংলাদেশ। অবশ্য আগের ইনিংসের শেষের দিকেও এসেছিল বৃষ্টির বাগড়া। সেটি বেশিক্ষণ স্থায়ী না হওয়ায় নির্বিঘ্নে ২০ ওভার শেষ করেছিল সাকিব বাহিনী।

শেষ হলো বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। যার শেষ দুটি ম্যাচ ছিল আমেরিকার ফ্লোরিডা রাজ্যের লাউডারডেল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। কথায় বলে শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। সব ভালো নিয়েই দেশে ফিরছে বাংলাদেশ। টেস্টে দুই শূন্যতে হারলেও ওয়ানডে এবং টি টুয়েন্টিতে বাংলাদেশ জিতল দুই-এক এ। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায়-রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাওগো এবার যাবার আগে। সেরকমই, দেশে যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে গেল টাইগাররা।

ফাইনাল বলে রোববারের ম্যাচ নিয়ে বাংলাদেশিদের আগ্রহ ছিল  অনেক বেশি। আবেগ, ভালোলাগা, রোমাঞ্চ সব মিলিয়ে টাইগার সমর্থকদের কাছে দিনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই এদিন টিকিটের  চাহিদা ছিল বেশি। কাউন্টারে যেমন ভিড় ছিল, তেমনি যাদের হাতে টিকিট ছিল তাদের কাছে টিকিট চেয়েছিলেন অনেকেই। অন্যদিকে আগের ম্যাচ হেরে হতাশ হয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকরা। তাই শেষ ম্যাচে তাদের উপস্থিতি বলতে গেলে ছিলই  না। তারা যেন আগে থেকে বুঝতে পেরেছিলেন ফলাফল।

 


গ্যালারি উপচে পড়া বাংলাদেশি সমর্থক। এ যেন আমেরিকার মাটিতে এক টুকরো বাংলাদেশ

 

অন্যদিকে শুরু থেকে শেষ অবদি পুরো গ্যালারি জমিয়ে রেখেছেন বাংলাদেশের সমর্থকরা। ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে মুখর ছিল  পুরো স্টেডিয়াম চত্বর।

হাজার বিশেক ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামে হাজার সতের দর্শক ছিলেন। তার ৯৮ শতাংশই ছিলেন বাংলাদেশের সমর্থক। ঢাক, ঢোল, খোল, খঞ্জনি, জাতীয় পতাকা, নিরাপদ সড়ক চাই লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসেছিলেন তারা। এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য থেকে। উদ্দেশ্য দেশকে সমর্থন দেয়া এবং ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া। দু’চোখ ভরে তারা দেখেছেন কাঙ্ক্ষিত জয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধও এসেছিলেন খেলা দেখতে। তারা নেচে গেয়ে পুরো স্টেডিয়ামকে বানিয়ে ফেলেছিলেন এক টুকরো বাংলাদেশ। এ যেন সদ্য ফোঁটা পদ্ম কানন।

বাংলাদেশের ছাত্রদের আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে আমেরিকার মাটিতেও। বিশেষ করে তরুণরা গ্যালারি মাতিয়ে রাখেন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে। তাদের অনেকের হাতেই ছিল ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড।

উজ্জ্বল নামের এক যুবক এসেছিলেন কলারাডো থেকে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন। বললেন, বাংলাদেশের খেলা দেখার জন্য মাস খানেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। সিরিজ জয়ে উচ্ছ্বসিত উজ্জ্বল বলেন, ‘ওয়াও, এ্যামেজিং, এ্যওয়েসাম। রিয়েলি এক্সাইটেড। ভাবতেই পারি নাই এতো ভালো করবে বাংলাদেশ। সার্থক আমাদের কষ্ট। এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।’ তিনি যোগ করেন, আমেরিকা প্রবাসী নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিরা এই জয়ে ভীষণ উজ্জীবিত।

অবশ্য রোমাঞ্চিত সাকিব তামিমরাও। টাইগাররা মিডিয়াকে বলেছেন, আমেরিকার এই সফরটা তাদের জন্য রোমাঞ্চকর। কারণ কী? মুখে না বললেও অনুমান করা যায়, খেলাটা আমেরিকার মাটিতে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশে। যেখানে ক্রিকেটের প্রচলন খুব একটা নেই বললেই চলে। কিন্তু ফ্লোরিডা কর্তৃপক্ষ চাইছে ক্রিকেটটা এখানে জনপ্রিয় হোক।

ফ্লোরিডার লাউডারডেল ডেভির বাসিন্দা নিয়ামুল হুদা। কয়েক দিন ধরেই এই খেলা নিয়ে তিনি ব্যস্ত। বিশেষ করে যারা বাংলাদেশ থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর থেকে এসেছেন লাউডারডেলে খেলা দেখতে তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। সিরিজ জয়ের পর তৃপ্তির হাসি তার চোখে মুখে। জানালেন, আজ বাংলাদেশি হিসেবে ভীষণ গর্ব হচ্ছে। টি টুয়েন্টির পরাশক্তি বিশ্বকাপজয়ী ওয়েষ্ট ইন্ডিজকে খুব সহজেই পর পর দুই ম্যাচে হারালো বাংলাদেশ। আমরা ভীষণ গর্বিত। তার মতে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত নতুন প্রজন্ম দেশকে নিয়ে আরো গৌরব বোধ করবে। ক্রিকেটের প্রতি তাদের ভালোবাসা বাড়বে, বাড়বে দেশপ্রেম।

 


নানা রকম প্ল্যাকার্ড নিয়ে গ্যালারি মাতিয়ে রেখেছিলেন বাংলাদেশি দর্শকরা

এ নিয়ে বিদেশের মাটিতে দুটি টি টুয়েন্টি সিরিজ জিতল  বাংলাদেশ। প্রথমটি এসেছিল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে।
বাংলাদেশ থেকেও অনেকে খেলা দেখতে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশ এবং ক্রিকেটের প্রতি তাদের ভালোবাসা থেকেই তারা এটা করেছেন।

তবে বাংলাদেশের এই আমেরিকা জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও ধন্যবাদ দিতে হবে। সিরিজের শেষ দুটো ম্যাচ ফ্লোরিডায় আয়োজন করে ইতিহাস রচনার সুযোগ তো আসলে তারাই করে দিয়েছেন।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হয়তো অনেক ক্রিকেট ম্যাচ জিতবে। একদিন হয়তো বিশ্বকাপও জিতবে। জিতবে এশিয়া কাপ। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মতো আরো অনেক ট্রফি। কিন্তু আমেরিকার মাটিতে প্রথমবার খেলতে এসে সিরিজ জয়-কোনো অংশেই কম নয়। এই জয় হোক অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশের আগামী দিনের সঞ্জীবনী সুধা। রাজনীতি, শৃঙ্খলা, শাসন, আইন ও বিচার, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে যত ক্ষোভ বিক্ষোভ থাক, ক্রিকেট এখনো পুরো জাতিকে এক সুঁতোয় গেঁথে রাখে। আরো সুদৃঢ় হোক জাতিসত্ত্বার এই বন্ধন। জয় হোক ক্রিকেটের, জয় হোক বাংলাদেশের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *