৭১- এর মার্চ মাসেই সিদ্ধান্ত নেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে মুক্তিযুদ্ধে। ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দিলে বাঙালী জাতি গর্জে উঠে। ২৫ দিনের একটানা অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানী বাহিনী নিমর্ম গণহত্যা শুরু করে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের স্বশস্ত্র লড়াই। তখন আমি ১০ম শ্রেণীর পরিক্ষার্থী। ১লা এপ্রিল আমি আমাদের বাংলা ঘরে অত্যন্ত গোপনীয় ভাবে ১০/১২ জন ছাত্র যুবক একত্রে বসি। তার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, আগামী কল্য এপ্রিলের ২ তারিখে ভারতের উদ্দেশ্যে চলে যাব । আমি আমাদের গ্রামে একজন ইন্ডিয়ান পাতা বিড়ি শ্রমিক আবু সাইদ কে ভাই বলে ডাকতাম। সে তখন ভারতের সন্নিকটে একটি ইন্ডিয়ার পাতা বিড়ি ফ্যাক্টরীতে বিড়ি বাঁধার কাজ করতেন। আমাদের সমস্ত সিদ্ধান্ত তাকে খুলে বলি। সে আমার কথা শুনে তৎক্ষণাত রাজি হয়ে গেল। আমি তোমাদেরকে পথ দেখিয়ে ইন্ডিয়ার সীমানায় নিয়ে যাব। তারপর ১০/১২ জনের মধ্য হতে আমিসহ মাত্র ৪ জন হুমায়ুন কবির, নাসির উদ্দিন আহম্মেদ ও তুরন বাবু সকলে আমাদের পিতা-মাতা কে কিছু না জানিয়ে সাইদ মিয়ার সঙ্গে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। হাটঁতে হাটঁতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম এবং সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তারপর নাসির নগর থানা জজ বাড়ীর কাছে একটি স্কুলে প্রচন্ড মশার কামড়ে রাত্রি যাপন করি। তখন সি এন্ড বি রোড সহ পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যরা ঘন ঘন টহল দিত। সাইদ মিয়া তখন বলেন আমি রাস্তা গুলি দেখে আসি তোমরা এখানে অপেক্ষা কর। আমরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু সাইদ মিয়া আর ফিরে আসল না। পরে জানতে পারলাম সে , রাজাকারের হাতে ধরা পরে এবং নিজস্ব লোকজনের সহায়তায় সে ছাড়া পেলেন। তখন আমরা দিশেহারা হয়ে যায়। পরবর্তীতে আমরা ঐ এলাকার একজন মাষ্টারের সহায়তায় হাটঁতে হাটঁতে তেলিয়া পাড়া গেলাম। সেখানে কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোক পেলাম। তেলিয়া পাড়ার চা ফ্যাক্টরীতে তাদের ক্যাম্প ছিল এবং তারা আমাদের সেখানে নিয়ে গেল। ওখানে আমরা খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রাম নিয়ে তাদের মাধ্যমে ভারতে সিমনা হলে গেলাম। তারপর সিমনা গিয়ে অনেক ছাত্র যুবক দেখতে পেলাম । আমরা সেখান থেকে অম্পিনগর (৩নং সেক্টর) ট্রেনিং সেন্টারে একমাস স্বশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহন করে হেড কোয়ার্টার হোজামারা চার্লি কোম্পানীতে অবস্থান করি। সেখান থেকে আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে আমি ফরিদুল ইসলাম , খসরু মিয়া, হুমায়ুন কবির, সুলতান মিয়া ও গোলাপ মিয়া বাংলাদেশে প্রবেশ করি।আমাদের যুদ্ধের এলাকা ছিল বি.বাড়ীয়া নবীনগর, বাঞ্চারামপুর, কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাজার ও নরসিংদী রায়পুরা, বেলাব থানা এলাকা।বাংলাদেশে প্রবেশ করে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরন নি¤েœ উল্লেখ করছিঃ
১। ২৮ শে জুন ৭১ রায়পুরা থানার দৌলতকান্দির রেল লাইনের সন্নিকটে বিরাট ৩টি বৈদ্যুতিক টাওয়ার এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেই।
২। ৪ঠা জুলাই ভৈরব বাজার সিনেমা রোডে কুখ্যাত রাজাকার সংগঠক মোমতাজ পাগলাকে তার গদি ঘরে গুলি ও গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করি। সে হত্যার পরিকল্পনাকারী ছিল ভৈরবের ছাত্রনেতা ফকরুল আলম আক্কাছ । মোমতাজ পাগলার অপারেশন করতে গিয়ে আমাদের গ্রæপ লিডার আতিকুর রহমানসহ নুরু মিয়া শাহাদাত বরন করেন। আমরা কোন রকমে প্রানে বেঁেচ যাই।
৩। ১৯৭১ সালে ১৪জুলাই বেলাব থানার বড়িবাড়ির যুদ্ধটি ছিল আমার সবছেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ। তখন বেলাব থানায় অবস্থানরত বিভিন্ন গ্রæপের মুক্তিযোদ্ধারা সুবেদার আবুল বাশার সাহেবের নেতৃত্বে সেই সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। সেই যুদ্ধে সুবেদার আবুল বাসারসহ মোমতাজ উদ্দীন, ক্যাডেট খুরশেদ সহ মোট ৭/৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন তারপর আমরা সেই যুদ্ধে আল্লাহ্র অশেষ রহমতে কোন রকম প্রাণে বেঁেচ যাই। তখন সেখানে ২০/৩০ জন গ্রামের লোকজনদের একত্রে করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা গুলি করে হত্যা করেন । আমরা আবার ৩ জুলাই রামনগর গ্রামের সন্নিকটে তিতাস গ্যাস পাইপ লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেই এবং তিতাস গ্যাস পাইপ লাইনটি এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে গ্যাস বিচ্ছিন্ন করে দেই।
তার পর আমরা আবার ভারতে ফিরে যাই। ৭/৮ দিন ভারতে অবস্থান করে আমরা পুনরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে রায়পুরা থানায় নারায়ণপুর গ্রামে অবস্থান করি। সেখানে অবস্থান কালে হঠাৎ ২ আগস্ট খবর পাই আমার মমতাময়ী মা গ্রামের বাড়ী ভৈরব থানায় শ্রীনগরে মারা যান (ইন্নালিল্লাহি……)। তখন আমার ইচ্ছা হলো আমার মা কে একনজর দেখার কিন্তু তখন ছিল বর্ষাকাল। আমার গ্রামের আশে পাশে অহরহ পাক বাহিনী আনাগোনা। কিন্তু তাহা উপেক্ষা করে আমি আমার মা কে দেখার জন্য বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তখন সকল রাস্তা ঘাট পানি তলানো ছিল। আমি কিছু কঁচুরি পানা একত্রে করে তাহা মাথায় রেখে কোথাও বুক পানি কোথাও গলা পানি দিয়ে কোন রকম বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার মায়ের জানাজা শেষ হয়ে গেছে। আমি কোন রকম মায়ের মুখ খানি দেখে আবার নারায়ণপুর ফিরে আসি। পরবর্তীকালে আমাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক রায়পুরা থানার সাপমারা বাজারের সন্নিকটে রেল লাইনের কাট্টমারা ব্রীজটি উড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করি। তারপর ব্রীজটি উড়িয়ে দিয়ে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেই। তার কিছু দিন পর নরসিংদী মিতালী সিনেমা হলের মালিক রাজাকার সংগঠক ক্যাপ্টেন কুদ্দুসকে ধরে এনে নরসিংদী কলেজের পিছনে গুলি করে হত্যা করি তখন নরসিংদী ইরাল, হারুন ও কটিয়াদীর তুলশী বাবু আমাদের সাথে ছিল।
পরবর্তীকালে আমরা নবীনগর কান্তারামপুর এলাকায় প্রবেশ করি। তখন ঐ এলাকার লোকজনের কাছে জানতে পারলাম বাঞ্চারামপুর থানায় কিছু সংখ্যক হানাদার অবস্থান করেছেন আমরা ঐ এলাকার কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঐ থানায় অপারেশন চালাই।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের অঙ্গীকার হউক রাজাকার মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার।
“জয় বাংলা, বাংলাদেশ চিরজীবি হউক”
বীর মুক্তিযোদ্ধা
এ, কে, এম, ফরিদুল ইসলাম ভুঞা
সহকারী কমান্ডার (অর্থ)
ঢাকা মহানগর ইউনিট কমান্ড
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ
সাধারণ সম্পাদক
মুক্তিযোদ্ধা পূর্নবাসন সংস্থা
তেজগাঁও থানা, ঢাকা।