Featured জীবনযাপন

ভৈরবে ঈদকে সামনে নিয়ে মুখে রোজা রেখে ব্যস্ত সময় পার করছে পাদুকা শ্রমিকরা

মোঃ ছাবির উদ্দিন রাজু বিশেষ প্রতিনিধিঃ

ঈদকে সামনে রেখে মুখে রোজা রেখে ব্যস্ত সময় পার করছে পাদুকা শ্রমিকরা।
সারাবছর কাজের তেমন একটা চাপ না থাকলেও ঈদ এলেই কাজের চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সেই চাপ সামলাতে এখন দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন ভৈরবের পাদুকা কারখানার কারিগররা। ঈদকে সামনে রেখেই তাদের এই বিরতিহীন ব্যস্ততা।

পাদুকা কারখানার মালিক সমিতির হিসাব মতে, ভৈরবে ছোট-বড় প্রায় ৮-১০ হাজার পাদুকা কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের কারখানা রয়েছে ৩৫টি। ছোট কারখানাগুলোতে ৮ ডজন, মাঝারি কারখানায় ১২ ডজন ও বড় কারখানাগুলোতে গড়ে ২৫ ডজন করে জুতা তৈরি হয়। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র থাকা কারখানাগুলোতে দৈনিক দুইশ থেকে তিনশ ডজন জুতা তৈরি হয়। আর এই কারখানাগুলোতে কাজ করছে প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক।

এছাড়া কারখানায় উৎপাদিত জুতা সারাদেশে বাজারজাত করার জন্য ভৈরবে পাইকারী দোকান রয়েছে পাঁচ শতাধিক। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা জুতার পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, এখানকার উৎপাদিত জুতা অত্যন্ত মজবুত ও উন্নত মানের এবং দেশব্যাপী এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট ও ঢাকাসহ দেশের সবকটি জেলার পাশাপাশি বাহিরেও বাজারজাত হচ্ছে ভৈরবের উৎপাদিত পাদুকা।

জানা যায়, ঈদ মৌসুমে ভৈরবে পাদুকা খাতে ৩০০ কোটি টাকার বেশি আয় হয়। আর এই মৌসুমটিতে কারখানার কারিগরদের যেন একটুও দম ফেলার সময় থাকে না। বছরের যেকোন সময়ের চেয়ে এই সময়টিতে অধিক বেশি কর্মমুখর হয় পাদুকা কারখানাগুলো। প্রতিটি কারখানায় চলে শিশু ও নারী-পুরুষের জন্য রঙ-বেরঙের বাহারি ছোট-বড় সাইজ ও আধুনিক ডিজাইনের জুতা তৈরির কাজ। এছাড়া ডিজাইন তৈরি, সেলাই, কাটিং, সোল তৈরি, পেস্টিং, রঙ করা, সলিউশন করা, আপার তৈরি, ফিতায় বেনী করা, বক্স তৈরি ইত্যাদি বিভিন্ন রকম কাজের ভিন্ন ভিন্ন কারিগর যার যার কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকেন।

এসব কারখানার একেকজন কারিগর দৈনিক গড়ে ৫০০ টাকা করে উপার্জন করলেও ঈদের সময় এ আয় আরও বেড়ে যায়। তাই মৌসুমি সময়ের এতটুকু সুযোগও ছেড়ে দিতে রাজি নন তারা। তবে দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির বাজারে কাঙ্খিত মজুরি না বাড়ায় অসন্তোষ জানান কারিগররা।

পাদুকা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, পাদুকা কারিগররা ডজন হিসেবে মজুরি পেয়ে থাকেন। প্রকারভেদে কারিগররা প্রতিদিন ৫শ থেকে ৭শ টাকা হিসেবে মজুরি পেয়ে থাকেন। একজন কারিগর দৈনিক এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। স্বয়ংক্রিয় পাদুকা কারখানাগুলোতে মেশিন ম্যান মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আর হেলপার ৫ হাজার টাকা করে মাসিক বেতন পাচ্ছেন।

এছাড়া পাদুকা কারখানারগুলোর সাথে পাদুকা তৈরির কাঁচামালের দোকানের ভৈরবে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ভৈরবে পাদুকা তৈরির কাঁচামালের প্রায় ৫০০টির মত দোকান রয়েছে। এইসব দোকানে সারা বছর যে মালামাল বিক্রি হয় ঈদ আসলে তা দুই তিন গুন বেড়ে যায়।

পাদুকা কারখানার মালিক সোহেল মিয়া জানান, সারা বছর তেমন একটা কাজের চাপ থাকে না। কিন্তু ঈদ এলে কাজের চাপ কয়েকগুন বেড়ে যায়। তিনি আরো জানান, এই বছর কাঁচামাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে জুতা তৈরির সকল উপকরণের দাম অনেক বেশি। তারা মাল স্টক রেখে বাজারে সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যার কারণে এই বছর জুতা তৈরিতে খরচও বেড়ে গেছে। যদি কাঁচামালের দাম এই রকম থাকে তাহলে কারখানার মালিকদের তেমন লাভ হবে না বলে জানান তিঁনি।

এদিকে পাদুকা কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানিকারকরা কাঁচামালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদেরও পাইকারী বাজার থেকে বেশি দামেই মাল কিনে আনতে হচ্ছে। যার কারণে খুচরা বাজারে পাদুকা কাঁচামালের দাম কিছুটা বেড়েছে।
পাদুকা কারখানার কারিগর সানাউল্লাহ বলেন, ঈদ আসলে আমাদের কাজের চাপ বেরে যায়। তখন আমরা শুধু ৩-৪ ঘণ্টা ঘুমায় আর বাকি সময় দিন-রাত পরিশ্রম করে জুতা তৈরি করি। কিন্তু আমরা পরিশ্রমের সঠিক মূল্য পাই না। আমাদের দৈনিক মজুরি ৭৫০-৮০০ টাকা। পানি ছাড়া আমার সবকিছু এই টাকা থেকেই চলতে হয়। আমার পরিবারে আমিসহ ৫ জন সদস্য। জিনিসপত্রের যে ভাবে দাম বেড়েছে বাজারে ৫০০ টাকা নিয়ে গেলে কিছুই হয় না। এই মজুরি দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। যদি আমাদের দৈনিক মজুরি ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা করা হয় তাহলে আমরা পরিবার নিয়ে কিছুটা ভালো চলতে পারব।

পাদুকা কারখানার আরেক কারিগর হানিফ মিয়া বলেন, আমরা কাজ অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য পাই না। আজ থেকে ৫ বছর আগে যে মজুরিতে কাজ করছি এখনও সেই মজুরিতেই কাজ করি।
কিশোরগঞ্জ জেলা পাদুকা শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন পাদুকা শ্রমিকদের মুজুরী বৃদ্ধি করা নাহলে আগামীতে শ্রমিক নেতাগণ কঠিন কর্মসূচি গ্রহণ করবে।
পাদুকা কারখানা মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সবুজ মিয়া জানান, ঈদুল ফিতর হল পাদুকা ব্যবসার মূল সময়। এখানকার তৈরি জুতা মান সম্পন্ন হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে এর চাহিদা রয়েছে অনেক। যার কারণে ঈদ আসলে এই সময়টাতে ভৈরবের ছোট-বড় সকল কারখানায় জুতা উৎপাদন কয়েকগুন বাড়ায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় কারখানাগুলো সমান সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। বড় কারখানাগুলো উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন লোন পাচ্ছে কিন্তু ছোট কারখানাগুলো কোনো লোন পাচ্ছে না। ছোট-বড় সকল কারখানা নিয়েই গড়ে উঠেছে ভৈরবের এই বৃহতর পাদুকার শিল্প। এই শিল্পটিকে আরো সমৃদ্ধি করতে হলে বড় কারখানার পাশাপাশি ছোট কারখানাগুলোকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। এর জন্য তিঁনি ছোট কারখানাগুলোকেও যেন বিনা শর্তে লোন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন সরকারের কাছে এ দাবি জানান।
এসময় ভৈরবের তৈরি জুতা দেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি বিদেশেও যেন রপ্তানি করা যায় সে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সরকার কছে দাবি জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *