বিশেষ প্রতিবেদন

আমার স্মৃতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স : বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তোফাজ্জুল হক

*** একাত্তরের বীরত্বের স্মৃতিকথা *** আমার স্মৃতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স :

“”””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””

( পূর্বের লেখনী পুনরায় প্রকাশিত )
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তোফাজ্জুল হক
সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ভৈরব উপজেলা কমান্ড ও সাবেক চেয়ারম্যান,
১নং সাদেকপুর ইউনিয়ন পরিষদ
ভৈরব, কিশোরগঞ্জ।
মোবাইল নাম্বার – ০১৭১১৪৮৯০৬৭ “”””‘””””””””‘””””””‘””””””””””””””””””””””
১৯৭১সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বর হত্যাকান্ড, নারী ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও মানবতা লঙ্ঘনকারী রক্ত পিপাষু হায়েনা পাক হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরতরে উৎখাতের জন্য ও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প নিয়ে, আমাদের এলাকার যুবকদেরকে সংগঠিত করে, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য, রাতের অন্ধকারে পিতা-মাতার অঘোচরে-অজান্তে সম্ভাব্য জুন-জুলাই মাসে মৌটুপী গ্রামের আমি তোফাজ্জুল হক, আমার চাচাতো ভাই হামিদুল হক, মনোহরপুর গ্রামের আসমত আলী, রসুলপুর গ্রামের ফিরুজুর রহমান, খালেকুজ্জামান, এম.এ হামিদ, জামালপুর গ্রামের আঃ সাত্তার, কালিকাপ্রসাদ গ্রামের রিয়াজ উদ্দিন, কামাল উদ্দিন, রহমত উল্লাহ, শ্রীনগর গ্রামের আলাল উদ্দিন, আঃ মতিন, জালাল উদ্দিনসহ আরো অনেকে মৌটুপী গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার সুঠাম দেহের অধিকারী মাঝি সুরুজ আলী (বর্তমানে মৃত) ও তার সঙ্গীয়সহ নৌকাযোগে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই। {একটি কথা না বললেই নয় যাওয়ার প্রাক্কালে কেহ যাহাতে খোঁজ খবর না জানতে পারে এবং তৎসময়ে আমার দাদা মৌঃ ওয়াছিল উদ্দিন ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তার আপন মেয়ের ঘরের আদরের নাতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন (বাদল) বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি ও তাহার ফুফাত ভাই মৌটুপীর সেরবাজ গ্রামের মোঃ আশরাফুল হক (মুকুল) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমি এবং আমার চাচাত ভাই হামিদুল হকের পিছু নেয় কিন্তু তাদের বয়স আমাদের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় কোন এক ফাঁকে তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে সুরুজ আলী মাঝির বাড়ির ঘাটে বাধা নৌকাটির পাটাতনের নিচে নৌকা ছাড়ার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত আমরা লুকিয়ে থাকি। ফলে তাহারা আমাদের সঙ্গী হতে না পেরে অনেক কষ্ট পায়। প্রেসিডেন্ট দাদার ভয়ে এই লুকোচুরি করতে হয়েছিল।} ভারতের আগরতলা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া সরাইল বিশ্বরোডে পাক হানাদার ও রাজাকারদের নজরদারী বৃদ্ধি হওয়ায় অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে তিন (৩) দিন নৌকায় চলন্ত অবস্থায় অবস্থান করি। তৎসময়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকার প্রচলন ছিল না। ইঞ্জিনবিহীন নৌকায় বৈঠা, দাঁড় ও পাল তুলে অবশেষে সীমান্ত এলাকা মহেষখলায় মাঝি সুরুজ আলীর শুশুড় বাড়িতে রাত্রি যাপন করি। পরদিন সকাল ৯ ঘটিকায় সীমান্ত সংলগ্ন মহেষখলায় ফরেস্ট অফিসে রিক্রুটিং ক্যাম্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেকান্দর আলী নূরী সাহেবের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মৌখিক সাক্ষাৎকার শেষে উত্তীর্ণ হয়ে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেশখলায়, ইয়ুথ ক্যাম্পে বেশ কিছু দিন অবস্থান করি। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেশখলায় পাহাড়ের পাদদেশে ইয়ুথ ক্যাম্পে চীনা জোঁকের আক্রমণকে তোয়াক্কা না করে খিচুড়ী ও জঙ্গলী ডালসহ নিম্ন মানের খাবার গ্রহণ করে দিনাতিপাত করি। মহেষখলা থেকে মহাদেব হয়ে লংড়া ক্যাম্পে অবস্থান করি। অল্প কিছুদিন পর পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বাঘমারা ক্যাম্পে অবস্থান করতে হয়। পায়ে হেঁটে প্রায় ৫০ মাইল, এই পাহাড়ী দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বাঘমারায় পৌঁছতে হয়। বাঘমারা হইতে ট্রাক যোগে মেঘালয় রাজ্যের তুরা পাহাড়ের পাদদেশে ১১নং ট্রেনিং সেন্টার তুরায় সন্ধ্যায় পৌঁছি। যেহেতু সন্ধ্যায় ট্রেনিং ক্যাম্পে রিক্রুট করা হয় না সেহেতু আমরা গেইটে অবস্থান করি। হঠাৎ দেখিতে পাই, আমাদের পূর্বে আসা, ভৈরবের চাঁনপুর গ্রামের এ.কে.আর হাবিবুল বাহার, সে স্কোয়ার্ড কমান্ডার হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকায়, তাহার সহযোগিতায় রাতেই ট্রেনিং ক্যাম্পের ভিতরে প্রবেশ করি এবং পরিশ্রান্ত শরীরে মাটিতে শুয়ে থেকেই বিশ্রাম নেই। দীর্ঘ একমাস তুরায় ট্রেনিং শেষে ২০৫ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত আমাদের রসুলপুর গ্রামের হিন্দী ভাষায় পারদর্শী এম.এ হামিদকে কোম্পানী কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানি গঠন করা হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় “দি মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স”। সবাই মেঘনা পাড়ের ছেলে বলে দি মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স নামকরণ করা হয়। এসএমজি, রাইফেল, এলএমজি, এসএলআর’সহ অন্যান্য অস্ত্রের সাথে আমাদের কোম্পানীতে রকেট রেঞ্জার দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, ট্রেনিং শেষে ইন্ডিয়ান ওস্তাদগণ আমাকে পছন্দ করে আমার নামে এলএমজি অস্ত্র বরাদ্দ করেন। কিন্তু তৎকালিন এলএমজিটি আমার চেয়ে বড় ও ভারি হওয়ায় এবং অন্যদের চেয়ে বয়সে আমি অনেক ছোট হওয়ায় আমার কান্নাকাটিতে এলএমজি অস্ত্রটি আমাদের কোম্পানীর প্লাটুন কমান্ডার ইটনার আঃ সাত্তার ভাইকে পুনঃবরাদ্দ করে, তাঁহার বরাদ্দকৃত এসএমজি (স্ট্যানগান) আমাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। যাহার নাম্বার ছিল জেড-৫১৩৮। উল্লেখ্য ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে ফায়ার করে লক্ষবিন্দু (টিক্কা খানের মূর্তি) গুলি বিদ্ধ করতে না পারার কারণে আমাকে ভারতীয় ওস্তাদ আমার গালে স্বজোরে চপোটাঘাত করে। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বার লক্ষবিন্দুতে ফায়ার করতে সক্ষম হই। ওস্তাদের চপোটাঘাতের এই স্মৃতির কথা আজও ভূলতে পারিনি। ট্রেনিং শেষে ভাগ্যক্রমে দৈবাৎ উপস্থিত হন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানী, ফলে তিনিই আমাদের শপথ বাক্য পাঠ করান। তুরা, ১১নং সেক্টরের ট্রেনিং সেন্টার এর সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের।
টেনিং শেষ করে ইটনা, অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব ও মেঘনা নদীতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের মেঘনার রিভার অপারেশন ফোর্স এর কোম্পানী কমান্ডার হিসাবে এম.এ হামিদকে টেনিং সেন্টার হতে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১০৪জন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র-সস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ ট্রাকযোগে ভারতের সীমান্তের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ঢালুতে অবস্থান করি। বাংলাদেশের প্রবেশের আগে ঢালু মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান কালে ভারতীয় বি.এস.এফ এর অধিনায়ক বাজেৎ সিং এর নিদের্শে আমরা বাংলাদেশের সিমান্তবর্তী হালুয়াঘাট, নালীতাবাড়ী, হাতিবান্ধা ও বারমারি চেয়ারম্যান টিলায় পাকহানাদার বাহিনী ক্যাম্পে রাতের অন্ধকারে ঐ এলাকার কমান্ডার আব্দুল আলী বুতের সহযোগিতায় ভারতীয় বি.এস.এফ এর আর্টিলারী কভারীং ফায়ারে উক্ত পাকিস্তানী ক্যাম্পে অতকির্ত (রেইড) হামলা করি। উক্ত যুদ্ধে একজন মেজরসহ ২০জন পাকসেনাকে হত্যা করে আবারো ঢালু ক্যাম্পে ফিরে আসি এবং ঐ এলাকা শত্রু মুক্ত করি। পরদিন ভারতের ঢালু বি.এস.এফ ক্যাম্পের কর্ণেল কেডি রাজপুত চৌহান ও ক্যাপ্টেন বাজিৎ সিং একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের কোম্পানী কমান্ডার এম.এ হামিদকে ভারতীয় মুদ্রায় ১০০শত টাকা পুরষ্কৃত করেন। পরবর্তীতে লংরা ক্যাম্প অবস্থান করে আমরা কমলাকান্দা থানার নাজিরপুরে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তারা মিয়া গ্রুপের ৫জন শহীদ ও তারা মিয়ার গলায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ঐ বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই। পাঁচজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও তারা মিয়াকে নিয়ে আমরা লংড়া ক্যাম্পে ফিরে আসি। পাঁচজন শহীদ মুক্তিযুদ্ধাকে বাংলাদেশের মাটিতে কবর দেওয়া হয়। আমরা তাদের রক্তের শপথ নিয়ে আবারও পাকসেনাদের ওপর আক্রমন করি এবং উক্ত স্থান শত্রু মুক্ত করি। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার সময় নিজ এলাকা ভৈরবকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখতাম। এরইমধ্যে একদিন খবর এলো আমাদেরকে বাংলাদেশের ভিতরে গিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলায় কাজ করতে হবে। সে খবর পেয়ে কি যে খুশি হয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়ে লংড়া ক্যাম্প হইতে মহেশখলায় এসে কোম্পানী কমান্ডার হযরত আলীর কোম্পানীর মুক্তিযুদ্ধাদের সাথে সাক্ষাত হয়। আমরা মহেশখলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় উক্ত কোম্পানীর ভৈরব এলাকার চাঁনপুর গ্রামের এ.কে.আর হাবিবুল বাহার, শ্রীনগর গ্রামের নাজিম উদ্দিন, রাজাকাটা গ্রামের ইসলাম উদ্দিন, চন্ডিবের গ্রামের আব্দুুর রহমান রতন, রসুলপুর গ্রামের এম.এ শহীদ (মৃত), সৈয়দ হাবিবুর রহমান, জয়নাল আবেদীন (মৃত), একে মাইন উদ্দিন, মহি উদ্দিন, শাজাহান কবির ও কালিকাপ্রসাদের বাচ্চু মিয়া ও সিরাজ উদ্দিন (মৃত) সহ বিভিন্ন গ্রুপ হইতে প্রায় ৪১ জন আমাদের সাথে অর্থাৎ এম.এ হামিদ কোম্পানীর নেতৃত্বে মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স এ একীভূত হই। এতে আমাদের কোম্পানীর সদস্য সংখ্যা দাড়ায় ১৪৫ জন। সীমান্তবর্তী মহেশখলা ক্যাম্প হইতে ২টি বড় নৌকা ও ৫টি মাঝারি নৌকা নিয়ে আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রওয়ানা হই। ইঞ্জিন বিহীন নৌকাগুলি আনুমানিক ০৫ ঘণ্টা বৈঠা দ্বারা ও পালের মাধ্যমে চলন্ত অবস্থায় হঠাৎ আমি যে নৌকায় ছিলাম রাত্রি ০৯ টার সময় এক অচেনা অজানা জায়গায় পানির নিচে থাকা টিলাতে ঘষা লেগে ফাটল ধরে নৌকাতে পানি উঠতে থাকে। ফলে আমরা যার যার অস্ত্র উচিয়ে সাতরাতে থাকি। এতে আমরা প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অন্ধকারাচ্ছন্নে হতভম্ব হয়ে পড়ি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমরা পার্শ্বে অবস্থিত গ্রাম মনে করে অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে ডাঙ্গাতে উঠি এবং দেখিতে পাই ইহা আনুমানিক এক হাজার বর্গমিটারের একটি কবরস্থান। পরে জানা যায় ইহা ঘাটুয়া গোরস্থান। উপায়ন্তর না দেখে শেষবধি আমাদেরকে উক্ত কবরস্থানে রাত্রি যাপন করতে হয়। সকালে ওঠে পার্শ¦বর্তী গ্রামের বিভিন্ন জনের সহায়তায় ছোট ছোট নৌকা দিয়ে পারাপার হই। জানা যায় ইহা নেত্রকোনা জেলার পাঁচহাট গ্রাম। ইউনিয়ন কাউন্সিলে আমরা সকল মুক্তিযুদ্ধা আশ্রয় নিই। পরদিন ইউনিয়ন কাউন্সিল মাঠে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” জাতীয় সংগীতটি পরিবেশন করি এবং নিকটবর্তী মসজিদে বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধারা শুক্রবার জুমার নামায আদায় করি। দুইদিন অবস্থান করে আমরা ইটনা থানার জয়সিদ্দি গ্রামে পৌঁছি। জানতে পারি ইটনা থানা সদরে কোন পাকিস্তানি সৈন্য নেই। একমাত্র রাজাকাররাই অবস্থান করিতেছে। সেখানে বসেই ইটনা থানা শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা করি। ইটনার দেওয়ান বাড়ির জনৈক দেওয়ান সাহেবের সক্রিয় সহযোগিতায় ও পরামর্শে ইটনা আক্রমন না করে অভিনব কায়দায় প্রায় তিনশত রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করিয়ে ইটনাকে শত্রুমুক্ত ঘোষনা করি এবং বিপুল পরিমান অস্ত্র-সস্ত্র জব্দ করি। ইটনাকে শত্রু মুক্ত বজায় রাখার জন্য সহকারী কোম্পানী কমান্ডার, ইটনার সালা উদ্দিন, প্লাটুন কমান্ডার আব্দুস সাত্তার, মামুন, আনোয়ার কামাল’সহ তৎ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ইটনা অবস্থান করার জন্য রেখে আমরা মিঠামইন থানার ঢাকী গ্রামে এসে অবস্থান নিই। পরদিন আমরা মিঠামইন ত্যাগ করে অষ্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হই। প্লাটুন কমান্ডার ফিরুজুর রহমান (পরবর্তীতে উপসচিব) এবং আর্টিলারি আর্মিম্যান রকেট রেঞ্জারচালক ফজলুর রহমানের তত্ত্বাবধানে তৎ এলাকার মুক্তিযুদ্ধাদেরকে অষ্টগ্রামের দায়িত্ব অর্পন করে ও সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধা সোহরাবকে নিকলীর দায়িত্ব অর্পন করে আমরা ভৈরবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই।
ভৈরবের সর্বশেষ সীমানা সাদেকপুর ইউনিয়নের মেন্দিপুর গ্রামের মধ্যদিয়ে আমরা ভৈরবে প্রবেশ করি। কোম্পানি কমান্ডার এম এ হামিদ ভাই এর নির্দেশে যার যার বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেয়ে আমি আমার নিজ বাড়ি মৌটুপীতে দুইদিন অবস্থান করে, আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধাগণ ভবানীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করি। কোম্পানী কমান্ডার আমাদেরকে অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন গ্রামে দায়িত্ব বন্টন করে দেয়। ক্যাম্পে অবস্থান কালীন কালিকাপ্রসাদ রেল স্টেশনকে শত্রু মুক্ত করার জন্য কুলিয়ারচরে অবস্থানরত ভূঁইয়া বাহিনী ও বেলাব থানার নারায়ণপুরে অবস্থিত গফুর বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য কোম্পানী কমান্ডারের নির্দেশে আমি ও জালাল উদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়। ভূঁইয়া বাহিনী ও গফুর বাহিনী এবং গয়েস আলী মাষ্টারের সমন্বয়ে কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশনে অবস্থানরত রাজাকারদের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনার দিন তারিখ ঠিক করা হয়। অন্য দিকে ভৈরবের রাজনগর ক্যাম্পে অবস্থানরত হুমায়ুন মোল্লার গ্রুপকে অবহিত করলে, তিনি প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন। অপর দিকে গাজীর টেক ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য সহকর্মী রহমত উল্লাহ ভূঁইয়া, মাঈন উদ্দিনকে দায়িত্ব দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর কমান্ডার মোঃ কামাল উদ্দিন ও জয়নাল আবেদীনকে প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক দ্রব্যাদি দেয়ার জন্য কোম্পানী কমান্ডার নিদের্শ প্রদান করেন। কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশন আক্রমণ করার দিন, ভোরে পাকবাহিনী শ্রীনগর গ্রামে এসে বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়ে গুলিবর্ষণ ও অগ্নি সংযোগ করার ফলে শ্রীনগর গ্রামবাসী দৌড়ে ভবানীপুর, রসুলপুর ও সাদেকপুর গ্রামের দিকে আসতে থাকে। তাদের মাধ্যমে খরব পেয়ে আমরা কালিকাপ্রসাদ আক্রমণের পরিকল্পনা তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করে শ্রীনগর অভিমুখে ডাবল মার্চ করে অগ্রসর হই। শ্রীনগর গ্রামের শেষ সীমানা, উত্তর প্রান্তে পৌঁছা মাত্রই পাক হানাদার বাহিনীর একেবারে মুখোমুখি হয়ে পড়ি ও সাথে সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই যুদ্ধে তিনজন পাকসেনা ও পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়, ভাগ্যিস আমাদের মধ্যে কেহ হতাহত হয়নি। উক্ত যুদ্ধে রণকৌশল হিসাবে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের জয়নাল আবেদীন বিস্ফোরক দ্রব্যাদির মাধ্যমে টু ইঞ্চি ও ফোর ইঞ্চি মর্টারের সেলের শব্দ সৃষ্টি করে। এর ফলে পাক বাহিনী বুঝতে পারে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট ভারী অস্ত্র-সস্ত্র আছে, তাই তারা পিছু হটে যায়। পাক বাহিনী পিছু হটে গেলে, আমরাও ভবানীপুর মসজিদের সামনে এসে অবস্থান নিই। ঘন্টা দুয়েক পরে আশুগঞ্জ থেকে লঞ্চ যোগে পাক বাহিনী মেঘনা নদী দিয়ে ভৈরবের দিকে আসছে, এ খরব র‌্যাকির (গোয়েন্দা) মাধ্যমে পেয়ে আমরা রসুলপুর মসজিদের কাছে অবস্থান করি। ইতিমধ্যে পাক হানাদার বাহিনী শ্রীনগর ব্যাপক গুলি করতে করতে এবং শ্রীনগর গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পিছু হটলেও লঞ্চ যোগে পাক বাহিনী নদী দিয়ে আসতে থাকায় তৎ সময়ে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। এই রকম সংকটে নিজ এলাকায় আমাদেরকে পড়তে হলো, তৎক্ষনাৎ আমরা ভাবতে থাকি, আমাদের মা-বাবা, আত্মীয় স্বজনকে পাক হানাদার বাহিনীর বুলেট ও বেয়নট এর সামনে ফেলে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাব, নাকি যুদ্ধ করে মরে যাব? গ্রামবাসী ও মা-বাবার অনুরোধে আমরা নৌকা যোগে কুলিয়ারচর চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। তারা আরোও বলে তোমরা যদি পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, তবে শ্রীনগরের মতো ভবানীপুর, রসুলপুর, সাদেকপুর, মৌটুপী ও মেন্দিপুর আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিবে এবং অনেককে গুলি করে মারবে। পরে জানতে পারি, এই যুদ্ধের প্রতিশোধ হিসাবে পাক হানাদার বাহিনী শ্রীনগর গ্রামের পাঁচ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। যাঁরা শহীদ হলেন আফসার উদ্দিন, ফয়েজ মিয়া, উভয়পিতা- গাজী মাহমুদ, মুলেক হোসেন, ফালু মিয়া, উভয়পিতা- ইসব আলী, ইসমাইল মিয়া, পিতা- মুছা মিয়া। আমরা কুলিয়ারচর পৌঁছে ঘাইলকাটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করি। কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশন শত্রু মুক্ত করার জন্য পুনরায় ভূঁইয়া বাহিনী ও গফুর বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে ত্রিমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা করি এবং কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশন রাজাকার মুক্ত করি। এই উল্লাসে গ্রামবাসীগণ দা, কুড়াল, বটি দিয়ে কতক রাজাকারকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। রাজাকার কমান্ডার দুর্ধর্ষ শাহাবুদ্দিন ঐ দিন ভৈরবে পাক বাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য ভৈরবে চলে আসার ফলে তাকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে পাক বাহিনী ভৈরব হইতে রেলযোগে কালিকাপ্রসাদ আসার পরিকল্পনা করছে খরব পেয়ে, আমরা পর দিনই ইঞ্জিনিয়ারিং কোর কমান্ডার মোঃ কামাল উদ্দিন ও জয়নাল আবেদীন এর নেতৃত্বে বিষ্ফোরকের ( এক্সপ্লোজিব ) মাধ্যমে গাজীটেকের রেল ব্রীজটি সম্পূর্ণরুপে উড়িয়ে দেই। এরপর থেকে পাক বাহিনী আর কোনদিন কালিকাপ্রসাদ অভিমুখে আসতে পারে নাই। ২৭শে অক্টোবর কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশন অপারেশনে ভূঁইয়া বাহিনীর কুমিল্লার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির নামীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁকে কুলিয়ারচর থানা মাঠে ২৮ শে অক্টোবর সকাল ০৯ ঘটিকায় জানাজা শেষে কুলিয়ারচর থানার মাঠের কোনায় স্ব-সম্মানে দাফন করা হয়। তাহার কবর এখনও বিদ্যমান। তারপর আমাাদের ক্যাম্প ভৈরবের গজারিয়া ধরবাড়িতে নিয়ে আসি। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাক সেনারা আত্মসর্মপন করলেও আমাদের ভৈরব শত্রু মুক্ত হলো না। ভৈরবে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থানের খোঁজ-খবর মিত্র বাহিনী কে জানানোর জন্য ১৮ ডিসেম্বর আমরা আমাদের কোম্পানি কমান্ডার এম এ হামিদ ভাইয়ের সাথে কতক মুক্তিযোদ্ধা আগানগর দিয়ে আজবপুর ও পানিশ্বর হয়ে আশুগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ঐ দিন রাতে আজবপুর গ্রামের মোতালিব বেপারীর বাড়িতে রাত্রি যাপন করি। ১৯শে ডিসেম্বর ভোর বেলা আশুগঞ্জ রেলস্টেশন ও সাইলো গোডাউনে অবস্থানরত ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ১৯ রেজিমেন্টের মেজর মেহেতার এর সাথে সাক্ষাত করে, ভৈরবে পাক বাহিনীর অবস্থান সমূহ বর্ণনা করি। তিনি তাৎক্ষনিক ভৈরবে এয়ার রেড করার জন্য নিদের্শ দেন, পরক্ষণে ভারতীয় দুটি জঙ্গী বিমান এসে মেঘনার তীরে পাক বাহিনীর ব্যাংকারে ও লঞ্চে বোমা ফেলে। বোমার আঘাতে পাক বাহিনীর লঞ্চটি সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ভৈরবে অবস্থানরত পাক সেনারা আত্মসর্মপন করে। এভাবেই ভৈরব শত্রু মুক্ত হয়। সমস্ত পাক সেনাকে ভৈরব রেলস্টেশন সংলগ্ন হাসপাতালে আটকে রাখা হয়। মিত্র বাহিনীর ১৯ রেজিমেন্টের কমান্ডার মেহেতার আমাদের কোম্পানী কমান্ডার এম.এ হামিদ সহ আমরা কতক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটি জীপ গাড়ীসহ এক প্লাটুন পাকসেনাকে সঙ্গে নিয়ে পাক সেনাদের ভাষ্য মতে ভৈরবপুর হাফিজ উদ্দিন মিয়ার বাড়ির উত্তরে ও হাজী কাদির বেপারীর বাড়ির উত্তরে ও পশ্চিমের মাঠের মাটির নিচ হইতে প্রচুর অস্ত্র-সস্ত্র মর্টার, কামান ও গুলাবারুদ, পাক সেনাদের ব্যবহার করা ট্যাংকার লরি ইত্যাদি রেলওয়ে স্কুলে এনে জমা করি। ঐ সময় আমাদের কোম্পানীকে মিত্র বাহিনীর একটি জীপ গাড়ি চালাতে দেয়। উক্ত জীপের চালক ছিল কৃষি ব্যাংকের দারোয়ান আব্দুল করিম। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন আট হতে পনের বছরের ছেলে-মেয়েরা পাক বাহিনী, রাজাকার ও দালালদের গতিবিধি আমাদের কাছে পৌঁছে দিত, ফলে আমাদের অপারেশন করা অনেক সহজ হয়েছিল। এছাড়া এলাকার স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ আমাদেরকে খাবার-দাবারসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য, প্রতিটি স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ, এই স্বাধীনতা সংগ্রামের সহযোদ্ধা ও বীরত্বের অংশীদার বলে মনে করি। “মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স” এ আমার সহযোদ্ধারা (লিখা অবস্থায় যাদের নাম স্মরণে ছিল) তারা হচ্ছেন- এম.এ.হামিদ (কোম্পানী কমান্ডার), ইটনার সালাউদ্দিন (টুআইসি), শ্রীনগর গ্রামের নাজিম উদ্দিন , ইটনার আব্দুস ছাত্তার (প্লাটুন কমান্ডার) চাঁনপুর গ্রামের এ.কে.আর.হাবিবুল বাহার (গ্রুপ কমান্ডার), মৌটুপী গ্রামের আমার চাচাতো ভাই হামিদুল হক, রসুলপুর গ্রামের এম.এ শহীদ (মৃত), সৈয়দ হাবিবুর রহমান, জয়নাল আবেদীন (মৃত), মাঈন উদ্দিন মাষ্টার, মহিউদ্দিন, শাজাহান কবির, খালেকুজ্জামান, ফিরোজুর রহমান(মৃত), শ্রীনগর গ্রামের আলাল উদ্দিন, আব্দুল মতিন, জালাল উদ্দিন, রাজাকাটা গ্রামের ইসলাম উদ্দিন, চন্ডিবের গ্রামের আঃ রহমান রতন (রতন), কালিকাপ্রসাদ গ্রামের কামাল উদ্দিন, রহমত উল্লাহ, আলী আজগর, বাচ্চু মিয়া, সিরাজ উদ্দিন, কালিকাপুরের আব্দুল করিম ও শাহাবুদ্দিন, জগমোহনপুরের রহমত উল্লাহ, কিশোরগঞ্জ সদরের আনোয়ার কামাল, শহিদুল হক, আব্দুল কাদির, কটিয়াদীর আব্দুল জব্বার, বাজিতপুরের খুর্শেদ আলম (মৃত), কুলিয়ারচর বড়াডোল এর গিয়াস উদ্দিন, কুলিয়ারচর, ফরিদপুরের এমদাদুল হক, রেফাত উল্লাহ, ছয়সূতি নোয়াগাও এর আব্দুল গফুর (মৃত), ইটনার আঃ ছাত্তার, এরশাদ,মামুন, সরুজ আলী, মোঃ ইদ্রিছ ভাই, কমলা কান্দার জামাল উদ্দিন ও কফিল উদ্দিন সহ আরো অনেকে, চট্টগ্রামের অধিবাসী বাবু সমির চন্দ্র ও নোয়াখালীর আব্দুল জলিল সহ আরো অনেকে। তেঁতাল্লিশ বছর পর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজ অনেকের নাম ও ঘটনার অবতারণ করতে পারিনি। আশা করি ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের সকল ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারব। ইনশাল্লাহ।

তারিখ ঃ ০১-১২-২০১৪ইং
লেখক ও স্মৃতিচারক-
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তোফাজ্জল হক
পিতা- মৃত মোঃ আঃ হক
গ্রাম- মৌটুপী (কর্তাবাড়ী)
পোঃ- সাদেকপুর,
উপজেলা- ভৈরব,
জেলা- কিশোরগঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *