এ.আর. মুশফিক: ধীনতার ২৪ দিন পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন। এরপর গঠন করা হয় বাংলাদেশ গণপরিষদ (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ)।
সংবিধান প্রবর্তন শেষে মাত্র দুটি অধিবেশনের মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর গণপরিষদ বিলুপ্ত করা হয়। গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে তত্কালীন সংসদ ভবনে গণপরিষদের প্রথম বৈঠক হয় ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল হয়। ওই দিন সকাল ১০টায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। তখন স্পিকার ছিলেন শাহ আব্দুল হামিদ।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে বাংলার যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের মহান আত্মার প্রতি এই পরিষদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে এবং তাদের শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খান সেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে, তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায়নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পশু সেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ায় আর কোথাও নাই।
তিনি বলেন, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আমরা যে সংবিধান দেব, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে। আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তাঁরা দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, হাজার হাজার ছেলে পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্য কিছু করতে পারি নাই। আমাদের বাংলার গ্রামকে-গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমাদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। এরকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তাঁরা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন, সেজন্য তাঁদের যদি মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে।
আজকে জনগণ কী অসুবিধায় আছে। তাদের থাকার ঘর নেই, আমরা কিছু দিতে পারছি না, মানুষ কষ্ট করছে। হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। অর্থ নাই, জনসাধারণকে সুবিধা করে দিতে পারছি না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।
পাকিস্তানে যে চার লক্ষের অধিক বাঙালি আটকে পড়ে আছে, তাদের বিষয়ে আমরা সমস্ত দুনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। পাকিস্তান সরকারকেও বলা হয়েছে, আমাদের লোকদের ফিরিয়ে দাও, আর এদেশে যারা থাকতে না চায়, তাদের ফিরিয়ে নাও, আমি তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি।
তবে যারা জঘন্য, যারা এই দেশে পাশবিক অত্যাচার করেছে, লুট করেছে। তারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবে।