বিশেষ প্রতিবেদন

জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান মিয়ানমারের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযান ও গণহত্যার বিষয়ে দেওয়া জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটি।

বিবিসি জানিয়েছে, বুধবার মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ হতে বলেছেন, তার দেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের দেওয়া প্রতিবেদন মেনে নিতে কিংবা তা গ্রহণ করতে পারছে না। তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে মিয়ানমার জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এটি প্রথম প্রতিক্রিয়া। এর আগে, চীন জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, মিয়ামারের ওপর চাপ প্রয়োগে সমস্যার সমাধান হবে না।

রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ করে সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘের দপ্তরে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

এতে বলা হয়েছে, রাখাইনে ব্যাপকহারে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার বাহিনীর অভিযানের উদ্দেশ্যই ছিল গণহত্যা। এ জন্য মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ করেছে এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে রাখাইনে মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ ছয় জেনারেলের বিচারের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা বন্ধে সেনাবাহিনীর রাশ টানতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ব্যর্থ হয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এরপর মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ দোষী সেনা কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিকভাবে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানানো হয়।

কিন্তু বুধবার মিয়ানমার জাতিসংঘের ওই তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছে। এতে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ হতে বলেন, আমরা জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনকে মিয়ানমারে প্রবেশের অনুমতি দেইনি। তাই মানবাধিকার মানবাধিকার পরিষদের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই এবং তাদের সুপারিশও গ্রহণ করতে পারছি না।’ জ হতে এক্ষেত্রে তার দেশের স্বাধীন কমিশনের তদন্তের কথা বলেছেন।

 

রাখাইনে ২০১৬ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ওই তথ্যানুসন্ধানী মিশন গঠন করে। ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মারজুকি দারুসমানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং শিশু ও সশস্ত্র সংঘাতবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ের রাধিকা কুমারাস্বামী ও অস্ট্রেলিয়ার মানবাধিকার পরামর্শক ক্রিস্টোফার সিডোটি।

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত এক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করে অন্তত ৮৭৫ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জাতিসংঘের এই তথ্যানুসন্ধান মিশন প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

তথ্যানুসন্ধানী মিশনের সদস্যরা বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র, ভিডিও, ছবি ও স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, গবেষক আর কূটনীতিকদের সঙ্গে অনেকবার বৈঠক করেছেন।

২০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের জেনারেলদের তদন্ত করে ‘যথাযোগ্য’ আদালতে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার মতো যথেষ্ট তথ্য পেয়েছে তথ্যানুসন্ধানী মিশন।

মিয়ানমার সরকার বলে আসছে যে, রাখাইন অঞ্চলকে জঙ্গিদের ঝুঁকিমুক্ত করার জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযান চালানো হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সামরিক প্রয়োজনে নির্বিচারে হত্যা, গণধর্ষণ, শিশুদের ওপর হামলা এবং পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কখনো সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।’

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু চৌকিতে সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার হামলার অভিযোগ করে রাখাইনে অভিযান চালায় মিয়ানমার বাহিনী। তারা সেখানে রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়, নারীদের ধর্ষণ করা হয় এবং নির্বিচারে গুলি করে বহু মানুষকে হত্যা করে।

মিয়ানমার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দীর্ঘ সময় ধরে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে।

এর আগে বিভিন্ন সময় প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে কক্সবাজারে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের ওপরে। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *