বিএনপি রাজনীতি

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হবে কোথায়?

সরকার চাইলে খালেদা জিয়াকে দেশে কিংবা বিদেশে তাঁর পছন্দমতো চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে

গণমাধ্যমে এ সপ্তাহের আলোচিত চরিত্র কী? ঈদে ঘরমুখী যাত্রীদের ভোগান্তি, ট্রাম্প-কিন শীর্ষ বৈঠক, নাকি বাজেট? আমার মনে হয়, সব ছাপিয়ে আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে—হাসপাতাল এবং বলা বাহুল্য, হাসপাতাল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারণে।
খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন—এটি এখন আর কোনো সংবাদ নয়। তিনি যদি জামিন পেয়ে যান, সেটি হবে সংবাদ। শিগগিরই তিনি জামিন পাবেন বলে মনে হয় না। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনের আগে।
নাজিমুদ্দিন রোডের ওই পরিত্যক্ত জেলখানা থেকে খালেদা জিয়া বেরিয়ে আসতে চাইছেন। তাঁর পরিবার ও দলের লোকদের দাবি, তিনি গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য অবিলম্বে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। যেহেতু তিনি সরকারের হেফাজতে আছেন, তাঁর দেখভাল করার দায়িত্ব সরকারের। সব বন্দীর জন্য সরকারের একই রকম আচরণ হওয়া সমীচীন। তবে তা হয় না। গুরুত্বপূর্ণ বন্দীরা কারা কর্তৃপক্ষের বিশেষ মনোযোগ পেয়ে থাকেন। খালেদা জিয়াও পাচ্ছেন। শুধু তাঁর জন্য জেলার, ডাক্তার, নার্স, পাইক-পেয়াদা—সবই মজুত। একজন বন্দীর জন্য রাষ্ট্রের এত আয়োজন, এত খরচ কেন, এ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের চোখে এই বন্দী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
এ দেশে বিত্ত কিংবা প্রতিপত্তি খাটিয়ে খুনের মামলার দণ্ডিত আসামিও মাসের পর মাস হাসপাতালে থেকে চর্ব্যচোষ্য চাখতে পারেন। সুতরাং অসুস্থ খালেদা জিয়াকে কেন হাসপাতালে যাওয়ার এবং থাকার অনুমতি দেওয়া হবে না, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু গোল বেধেছে কারাবিধিতে। কারাবিধি পড়ে কারা কর্তৃপক্ষ সাব্যস্ত করেছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালেই (বিএসএমএমইউ) তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেখানে দেশের সব বাঘা বাঘা চিকিৎসক আছেন। তাঁদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী চিকিৎসা চলা উচিত। তাঁরা যদি মনে করেন, বাইরের কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার, তা তাঁরা করবেন। কিন্তু খালেদা জিয়া জেদ ধরেছেন, তিনি বিএসএমএমইউতে যাবেন না। তিনি যেতে চান ইউনাইটেড হাসপাতালে। ইউনাইটেড হাসপাতাল ঢাকার এলিট বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একটি। সেখানে অনেকেই চিকিৎসাসেবা নিতে যান। কিন্তু সে তো মুক্ত নাগরিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার। একজন কারাবন্দীর কি নিজস্ব পছন্দ থাকতে পারে? সরকার যেটা ভালো মনে করবে, তা-ই হবে।
খালেদা জিয়া ইউনাইটেড হাসপাতালে যেতে চাইছেন কেন? এটা কি স্বর্গের বাগান? আর বিএসএমএমইউ কি নরককুণ্ড? আসলে ব্যাপারটা তা নয়। খালেদা জিয়া সম্ভবত এর আগে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন কিংবা তাঁর পছন্দের চিকিৎসক আছেন ওই হাসপাতালে। রোগী সাধারণত তাঁর আস্থাভাজন চিকিৎসকের কাছেই যেতে চান। এই আস্থার পেছনে যুক্তি খোঁজার কোনো মানে হয় না। আস্থা তৈরি হয় পারস্পরিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে। যেমন আমাদের রাষ্ট্রপতি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সিঙ্গাপুর কিংবা লন্ডনে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে। এ জন্য রাষ্ট্রের অনেক টাকা খরচ হলেও মহামান্য রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টিই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই সামান্য হাঁচি-কাশির চিকিৎসার জন্য আকছার বিদেশে যাচ্ছেন। এতে তো দোষের কিছু নেই।
যেকোনো কারণেই হোক, খালেদা জিয়া চাইছেন ইউনাইটেড হাসপাতালে যেতে। তাঁর এই আগ্রহে বা প্রস্তাবে সরকার রাজি নয়। ব্যাপারটি শুধু কারা কর্তৃপক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই হতো। কিন্তু
এখন আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল, এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও এ নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। নানা রকম মন্তব্য করছেন,
আইন দেখাচ্ছেন।
শোনা যাচ্ছে, কারাবিধিতে কিছু নির্দেশনা ও বিধিনিষেধ আছে। কারাবিধিতে কী আছে, আমি জানি না। কারাবিধি অনুযায়ী কি খালেদা জিয়ার কয়েদির পোশাক পরা উচিত? তিনি কী পোশাক পরেন, জানি না। হয়তো বলা আছে সরকারি হাসপাতালেই তাঁকে চিকিৎসা নিতে হবে। সরকার এখন কারাবিধির ধারাগুলো ধর্মবাণীর মতো আঁকড়ে ধরেছে। একটু নড়চড় হলেই বুঝি মহাপাপ হবে!
আমাদের কারাবিধি তৈরি হয়েছিল অনেক আগে, ১৮৯৪ সালে। আমরা তখন ইংরেজের গোলাম ছিলাম। গোলামদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং শায়েস্তা করতে ইংরেজরা এটি তৈরি করেছিল। তারপর তো আমরা দুই-দুইবার স্বাধীন হলাম। কিন্তু সোয়া শ বছর আগের কারাবিধি সামান্য অদলবদল করে রেখে দিয়েছি আমরা।
কারাবিধি যখন তৈরি হয়, তখন ইউনাইটেড হাসপাতাল ছিল না। তখন প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। এখন সেবা খাতের বেশির ভাগই বেসরকারি খাতের দখলে। উপায় না দেখে জমিজমা বিক্রি করে হলেও আমরা অনেকেই বেসরকারি হাসপাতালে যাই চিকিৎসার জন্য। সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ছড়াছড়ি। সেবা পাওয়া যায় কম খরচে। তারপরও মানুষ ভিড় করে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে। কারণ, ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলে নাকি সরকারি হাসপাতালে মানসম্মত সেবা পাওয়া যায় না। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। তা ছাড়া, সরকারি মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা অনেকেই বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে বসেন, রোগী দেখেন, ব্যবস্থাপত্র দেন। একই চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে যেভাবে রোগী দেখেন, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে দেখেন অন্যভাবে।
এখানে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রতিবেদন লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বিষয়, খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হবে কোথায়? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিনি রাজি হলে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাঁকে নেওয়া যেতে পারে, অর্থাৎ সরকার তাঁকে ‘হাতের মুঠোর’ বাইরে যেতে দিতে নারাজ। সরকার হয়তো আশঙ্কা করছে, তিনি ইউনাইটেডে গিয়ে দলের লোকদের সঙ্গে নানা অছিলায় মিটিং করবেন, চিরকুট চালাচালি হবে; অর্থাৎ তিনি রাজনীতি করবেন।
একজন কারাবন্দীকে সরকার তাঁর পছন্দমতো চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দেবে কি না, তা-ই এখন প্রশ্ন। আমাদের অতীত ইতিহাস কী বলে? এ ক্ষেত্রে আমি দুটি উদাহরণ দেব।
১৯৭৬ সালে এক সামরিক ট্রাইব্যুনালে জাসদ নেতাদের বিচারে মৃত্যুদণ্ড থেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। জাসদের ওই সময়ের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তাঁর কানের সমস্যা ছিল।
জিয়াউর রহমানের সরকার ওই সময় তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে পশ্চিম জার্মানি যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। সেখানে তিনি কানের চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসার খরচ দিয়েছিল সরকার। জাতীয় সংসদে এক বিবৃতিতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান বলেছিলেন, আ স ম আবদুর রবের চিকিৎসার জন্য সরকারের পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্যারোলে থাকা অবস্থাতেই তিনি মুক্তি পান।
এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা—দুজনই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দেশে সামরিক আইন জারি না হলেও সামরিক বাহিনীই প্রকৃতপক্ষে দেশ পরিচালনা করছিল। তো, ওই সময় দেশের এই দুই জনপ্রিয় নেতাকে সাধারণ কারাগারে ঢোকানো হয়নি। জাতীয় সংসদ চত্বরে দুটি ভবনকে উপকারাগার ঘোষণা করে সেখানে তাঁদের রাখা হয়েছিল। ওই সময় কারাবিধি কতটুকু মানা হয়েছে, জানি না। তবে আর দশজন সাধারণ বন্দীর মতো আচরণ করা হয়নি তাঁদের সঙ্গে।
২০০৮ সালের ১৩ এপ্রিল বিকেলে রাষ্ট্রীয়
অতিথি ভবন মেঘনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বৈঠক করে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর দাবি জানান। অবশেষে শেখ হাসিনা প্যারোলে ছাড়া পান। প্যারোলের মেয়াদ ছিল ৬ আগস্ট ২০০৮ পর্যন্ত। ১২ জুন ২০০৮ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।
সরকার চাইলে খালেদা জিয়াকে দেশে কিংবা বিদেশে তাঁর পছন্দমতো চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। এতে তো সরকারের পতন হবে না।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com

সূত্র : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *