মোঃ ছাবির উদ্দিন রাজু লেখক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠক:
সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই মহররম মাস এক বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। হিজরি বা আরবি বছরের প্রথম মাস মহররম। অনেকের ধারণা কারবালায় নির্মম ঘটনার কারণেই ইসলামি শরিয়তে আশুরার এত গুরুত্ব। অথচ এ ধারণা ঠিক নয়। কেননা কারবালার ঘটনার বহুকাল পূর্বে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এ তারিখটি মুসলিম বিশ্বের কাছে গভীর শোকের দিন হিসেবে বর্নিত হয়ে আসছে।
মানব ইতিহাসের নানা তাৎপর্যময় ঘটনার সাক্ষী এই মাস। ইসলামপূর্ব আরবের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজেও মহররম মাসের বিশেষ মর্যাদা ছিল। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত পবিত্র চার মাসের অন্যতম মহররম। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মাসগুলোর গণনা আল্লাহর কাছে বারো মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোতে নিজদের ওপর কোনো জুলুম করো না।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)
একদিকে হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের কারণে আমাদের শোক প্রকাশের প্রয়োজন মনে হচ্ছে। অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় নবী হজরত মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তির জন্য আনন্দ প্রকাশ করা দরকার তাহলে আমরা এখানে কোনটি করব? তাই এখানে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো কিছু করা ঠিক হবে না বরং শরীয়ত যা করতে বলেছে এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই উভয় জাহানের জন্য কল্যাণকর। আশুরার দিনে পরিবারের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করার কথা আলোচনা হয়েছে। এখানেও একটি বিভ্রান্তি রয়েছে। প্রখ্যাত ফকিহ খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানি হাফিজাহুল্লাহ বলেন, মুসলিম শরিফে মহররমের দশ তারিখ রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। দুর্বল সনদের হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, পরিবারের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। রোজা রাখলে খাবার খাবে কীভাবে? তাই এটাও চিন্তার বিষয়। কোনো কোনো আলেমের মত হচ্ছে, হাদিস দ্বারা খাবার খাওয়ানো উদ্দেশ্য নয় বরং স্বচ্ছলভাবে চালানো উদ্দেশ্য। তখন রোজা রাখার হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না। কারণ খাবার না খেয়েও ওই দিন স্বচ্ছলভাবে চালানো যেতে পারে।
আশুরার দিনে সংঘটিত সর্বশেষ ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত। ইতিহাসটা অনেকটা এ রকম যে, কূফাবাসী একের পর এক চিঠি হজরত হুসাইন (রা.) এর কাছে পাঠাতে লাগলেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, তারা ইয়াজিদের পরিবর্তে আপনার হাতে বাইয়াত হতে চায়। এক পর্যায়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য মুসলিম ইবনে আকিলকে পাঠানো হয়। তখনো কূফার অবস্থা ছিল শান্ত। তাই কূফাবাসীর আবেগের কোনো কমতি ছিল না। তাই মুসলিম ইবনে আকিল হুসাইন (রা.) এর কাছে পত্র লেখে জানান যে, তাদের কথা বাস্তব আপনি কূফায় চলে আসুন। পত্র পাঠানোর পরপরই কূফার শাসক পরিবর্তন হয়। ইয়াজিদের পক্ষ থেকে উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কূফার শাসক হন। সে ছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তার হুমকিতে কূফাবাসী নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসে। এমনকি মুসলিম ইবনে আকিলকেও তারা থাকার সুযোগ দিতে রাজি হয়নি। এক পর্যায়ে তাকে গ্রেফতার করে হত্যা করা হয়। এদিকে এতকিছু হচ্ছে কিন্তু সে সংবাদ মদীনায় পৌঁছেনি। তাই হুসাইন (রা.) মুসলিম ইবনে আকিলের চিঠি মোতাবেক প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা হয়ে যান।
অবশেষে ৬১ হিজরির মহররম মাসের আশুরার দিন কারবালায় শাহাদাত বরণ করেন। তখন তার বয়স ছিল ৫৪ বছর ছয় মাস পনের দিন। বহু হাদিস দ্বারা প্রমাণীত যে, নবী করিম (সা.) জীবদ্দশায় হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের সংবাদ দিয়েছিলেন। যেমন উম্মে ফজল বিনতে হারেস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি একদিন নবী করিম (সা.) এর ঘরে গিয়ে বলেন, ইয়া রাসূল্লাহ! আমি একটি খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। রাসূল (সা.) বলেন সে স্বপ্নটি কী? সে বললো, আমি দেখেছি আপনার দেহ থেকে একটি গোশতের টুকরা আলাদা হয়ে আমার কাছে এসে পড়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ওটা ভালো স্বপ্ন তুমি দেখেছ। আমার কন্যা ফাতেমা ছেলে সন্তান জন্ম দেবে। ওই সন্তান তোমার কাছে লালিত পালিত হবে। রাসূল (সা.) এর ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী কিছু দিন পর ফাতেমা (রা.) এর ঘরে হুসাইন (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। উম্মে ফজলের কাছে লালন পালনের জন্য দেয়া হলো। কিছু দিন পর উম্মে ফজল তাকে নিয়ে আসেন রাসূল (সা.) এর কাছে। রাসূল (সা.) তাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। উম্মে ফজল বলেন, কী হয়েছে আপনার ইয়া রাসূল্লাহ! রাসূল (সা.) বলেন, এই মাত্র জিবরাইল (আ.) এসে আমাকে সংবাদ দিয়ে গেছেন যে, আমার এই সন্তানকে আমার উম্মতেরা হত্যা করবে। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৫১১)
হজরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের ব্যাপারে আমাদের সমাজে নানা রকম বিভ্রান্তি আছে। যেমন শিমার যখন হজরত হুসাইন (রা.) এর গলা কাটতে পারছিল না তখন হুসাইন (রা.) ওয়াদা দিয়েছিলেন উল্টো দিক থেকে কাটলে আমার জান সহজে বের হবে। এই উপকারের জন্য কিয়ামতের দিন আমি তোমাকে ছাড়া জান্নাতে যাবো না। আরো বলা হয়, ওই দিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, আকাশের রং পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল, পাথর উল্টালেই রক্ত বের হত, সমস্ত গোলাপ ওই দিন শুকিয়ে গিয়েছিল ইত্যাদি। ইবনে কাছির (রাহ.) এগুলো বর্ণনা করার পর লেখেন ‘আমাদের থেকে নবী করিম (সা.) বিদায় নিয়েছেন, তিনি ছিলেন মানব জাতির সর্দার কিন্তু তার মৃত্যুতে এমন কিছু হয়নি। তেমনিভাবে উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হজরত আবু বকর (রা.) আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু তার মৃত্যুতে দুনিয়াতে এমন কিছু ঘটেনি। এভাবে হজরত ওমর, ওসমান ও আলী (রা.) এর মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেন। আল্লাহ তায়ালাই এ ব্যাপারে ভালো জানেন।’ (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৫১২) অতএব, তার কথা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, পূর্বোক্ত ঘটনাগুলো মূলত বানোয়াট, যার কোনো ভিত্তি নেই।
মীর মোশাররফের বিষাদ সিন্ধু মূলত এ সকল ঘটনাকে অবলম্বন করেই লেখা। তাই ঘটনা শুনতে চমৎকার মনে হলেও বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। আশুরার দিনে তাজিয়া মিছিল, শরীরকে কাটাছেড়া করা, শোক দিবস হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন ইত্যাদিও এ দিবসকে নিয়ে ভ্রান্ত চিন্তার কারণে। ইয়াজিদের ওপর লানত বর্ষণ করাও গোনাহের কাজ। আশুরার দিনে কেউ কেউ সুরমা লাগাতে বলে। এর কোনো ভিত্তি নেই।