এ.আর. মুশফিক: রাজধানীতে অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট সিন্ডিকেটমুক্ত হতে পারছে না। এবারও হাটের ইজারা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কয়েক দফায় টেন্ডার আহ্বান করেও সিন্ডিকেটের কারণে পশুর হাট নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে করপোরেশন। ফলে অস্থায়ী হাট থেকে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৩টির মধ্যে ৭টিতে কোনো দরপত্র জমা পড়েনি। ডিএসসিসি এর চূড়ান্ত না হওয়া হাটগুলো হলো-কমলাপুর ব্রাদার্স ইউনিয়নের বালুর মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, কমলাপুর স্টেডিয়ামের রাস্তার পূর্ব পাশসংলগ্ন খালি জায়গা, আরমানিটোলা খেলার মাঠসংলগ্ন আশপাশ ও খালি জায়গা, ধূপখোলার ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, দনিয়া কলেজ মাঠসংলগ্ন খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠ।
অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চূড়ান্ত হওয়া হাটগুলোও সিন্ডিকেটের হাতে রয়েছে। সিন্ডিকেটের প্রভাবে ১০টি হাটের মধ্যে দুটি হাটের কাঙ্খিত দর আসেনি। হাট দুটি হলো-উত্তরখানের ময়নারটেক মাঠ। এ ছাড়া আশিয়ান সিটির হাটের জন্য এখনও কাঙ্খিত দর পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতি বছরই রাজধানীর অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারা পাচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। দীর্ঘদিন ধরে একই বলয়ের ব্যক্তিরা হাট পরিচালনা করায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কমর্চারী তাদের সহায়তা করছেন। সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে ইজারা পাওয়া তো দূরের কথা কেউ সিডিউল জমাই দিতে পারেন না। এতে মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
সূত্র আরো জানায়, সবচেয়ে কম মূল্যে এসব হাট ইজারা নিতে প্রথম থেকেই কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয় প্রভাবশালীরা। ফলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা টেন্ডার প্রক্রিয়ার ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারেননি। তাদের সিন্ডিকেটের কব্জায় পড়ে ৮টি হাটের জন্য কোনো দরপত্রই জমা পড়েনি। ঈদের আগ মুহূর্তে এই হাটগুলো সিটি করপোরেশন থেকে ইজারা আদায়ের অনুমতি নেওয়ার পাঁয়তারও করছে তারা।
ডিএসসিসির নির্ধারিত কামরাঙ্গীরচর চেয়ারম্যান বাড়ি মোড় থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধসংলগ্ন খালি জায়গায় অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হোসেন সরকার। এ হাটের জন্য ৩টি দরপত্র ক্রয় করা হলেও জমা পড়ে মাত্র একটি। যিনি গত ১০/১২ বছর ধরে হাটটির ইজারা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এ হাটটির সরকারি দর ছিল ৫ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা। তিনি দর দিয়েছেন ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে মাত্র ৬০০ টাকা বেশি দিয়ে হাটটি নিয়েছেন তিনি। ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা গত এক দশক ধরেই এমন অল্প মূল্যেই হাটটির ইজারা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
উত্তর শাজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারস্থ মৈত্রী সংঘ মাঠে পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন ১১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল লতিফ। গত বছরও এই হাটের ইজারা পেয়েছিলেন তিনি।
অপরদিকে ডিএনসিসির ছয়টি হাটের ইজারাও পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দল ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কমীর্রা। এর মধ্যে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর গোলচত্বরসংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি ইজারা পেয়েছে মেসার্স শফিক অ্যান্ড ব্রাদার্স। প্রতিষ্ঠানটির মালিক উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম। এ হাটের সরকারি মূল্য ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ ১৮ হাজার ২৭৮ টাকা। তিনি দর দিয়েছেন ২ কোটি একুশ লাখ টাকা। গত বছর হাটটি ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়।
ভাটারা (সাঈদ নগর) পশুর হাটের ইজারা পেয়েছেন ভাটারা থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মারফত আলী। সরকারি মূল্য ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার ৯৬৭ টাকার বিপরীতে তিনি দর দিয়েছেন ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
ইজারা যার নামেই হোক, হাট এই সিন্ডিকেটের দখলেই যাচ্ছে পুরানো ইজারাদারদের সিন্ডিকেটের হাতে। এবারও জিম্মি রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটগুলো। এতে বিপাকে পড়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। দফায় দফায় টেন্ডার আহ্বান করেও ২৩ হাটের মধ্যে ১৫টি হাটের ইজারা সম্পন্ন করতে পেরেছে। ৮টি হাটের ইজারা প্রদান এখনও অনিশ্চিত। এতে সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দরপত্র আহ্বানের পরপরই টেন্ডার জমা দেওয়ার নির্ধারিত স্থানের আশপাশে এই সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকে পাহারাদার নিয়োগ করা হয়। সিন্ডিকেটের বাইরের কেউ চাইলেও দরপত্র জমা দিতে পারে না। কেউ দরপত্র জমা দিলেও তা প্রত্যাহারের জন্য নানা মহল থেকে চাপ আসে। এ বছর সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ টেন্ডার জমা দিতে পারেনি।
গত বছর ইজারা আদায় করা হয়েছে এমন একটি হাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি বলেন, ইজারা না হলেও খরচ কম না। সবাইকেই খুশি করা লাগে। তবে স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের কিছু আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য প্রতি বছরই এলাকার হাটটি পান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত বছর ডিএসসিসির এক হাটের ইজারায় অংশ নেওয়া এক প্রভাববশালী ব্যক্তি বলেন, অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পাড়ি দিয়ে গত বছর সিডিউল জমা দিয়েছিলাম। সেটি টের পেয়ে সিডিউল প্রত্যাহারের জন্য নানা হুমকি ধামকি দেওয়া হয়। জীবনের ঝুঁকি বিবেচনা করে এবার আর দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেইনি।
কয়েকজন ইজারাপ্রত্যাশী অভিযোগ করে বলেন, হাট ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে নূন্যতম তিনটি দরপত্র জমা পড়তে হয়। সাধারণ ইজারাদাররা দরপত্রই কিনতে পারেননি। দু’একজন কিনলেও ভয়ে জমা দেননি বা জমা দেওয়ার সুযোগ পাননি। ফলে সিটি করপোরেশন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আবদুল মালেক বলেন, নিয়ম অনুযায়ী তিন দফা দরপত্র আহ্বান করে ৭টি হাটের ইজারা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও যে হাটগুলো চূড়ান্ত হয়নি সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেবে।
তিনি বলেন, নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নিয়ম মেনেই শীর্ষ দরদাতাকে হাটের ইজারা সম্পন্ন করা হচ্ছে।
ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে টেন্ডার হয় অনলাইনে ও প্রকাশ্যে। এরপরও কেউ সিন্ডিকেট কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ করলে কিছু করার নেই। একাধিক ব্যবসায়ী সমঝোতার ভিত্তিতে টেন্ডারে অংশ নেন।
তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা ৮টি হাট বসানোর কার্যক্রম চূড়ান্ত করেছি। দুই দফা টেন্ডার কার্যক্রমের মধ্যে ১ম দফাতেই ৬টি হাটে কাঙ্খিত দর পাওয়া গিয়েছিল।