১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বর হত্যাকান্ড, নারী ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও মানবতা লঙ্গনকারী রক্ত পিপাষু হায়েনা পাক হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরতরে উৎখাতের জন্য ও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প নিয়ে ভারত ১১নং সেক্টরের তুরায় ট্রেনিং শেষ করে বর্ডারের বেশ কয়েকটি স্থানে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে আমরা ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইন শত্রুমুক্ত ঘোষণা করে নৌকাযোগে ভৈরবের সর্বশেষ সীমানা সাদেকপুর ইউনিয়নের মেন্দিপুর গ্রামে মেঘনার ঘোরাউতরা নদীর পাড় দিয়ে আমরা ভৈরবে প্রবেশ করি। আমরা নিজ গ্রাম মোটুপীতে অন্যন্যরা যার যার গ্রামে দুইদিন অবস্থান করে, আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধাগণ ভবানীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এসে ক্যাম্প স্থাপন করি। কোম্পানী কমান্ডার এম.এ হামিদ আমাদেরকে অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন গ্রামে দায়িত্ব বন্টন করে দেয়। ক্যাম্পে অবস্থান কালীন কালিকাপ্রসাদ রেল স্টেশনকে শত্রুমুক্ত করার জন্য কুলিয়ারচরে অবস্থানরত ভূইয়া বাহিনী ও বেলাব থানার নারায়নপুরে অবস্থিত গফুর বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য কোম্পানী কমান্ডারের নির্দেশে আমাকে ও জালাল উদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়। ভূঁইয়া বাহিনী ও গফুর বাহিনী এবং গয়েস আলী মাষ্টারের সমন্বয়ে কালিকাপ্রসাদ রেল স্টেশনে অবস্থানরত রাজাকারদের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী আক্রমণ পরিচালনার দিন তারিখ ঠিক করা হয় অন্যদিকে ভৈরবের রাজনগর ক্যাম্পে অবস্থানরত হুমায়ুন মোল্লার গ্রুপকে অবহিত করলে, তিনিও প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন অপর দিকে গাজিরটেক ব্রীজ ধ্বংস করার জন্য সহকর্মী রহমত উল্লাহ ভূঁইয়া ও মাইন উদ্দিনকে দায়িত্ব দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর কমান্ডার মো. কামাল উদ্দিন ও জয়নাল আবেদীনকে প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক দ্রব্যাদি দ্বারা ডিনামাইট তৈরি করে রেখে দেওয়ার জন্য কোম্পানী কমান্ডার এম এ হামিদ নির্দেশ প্রদান করেন। কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশন আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেওয়াকালীন ঐদিন ভোরে পাক বাহিনী অতর্কিত শ্রীনগর গ্রামে এসে বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়ে গুলিবর্ষণ ও অগ্নি সংযোগ করার ফলে শ্রীনগর গ্রামবাসী দৌড়াদৌড়ি করে ভবানীপুর, রসুলপুর ও সাদেকপুর গ্রামের দিকে আসতে থাকে। ছুটাছুটি করে আসা লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে ও আগুনের লিলি শিখা দেখে আমরা কালিকাপ্রসাদ আক্রমণের পরিকল্পনা তাৎক্ষনিক বাতিল করে শ্রীনগর অভিমুখে ডাবল মার্চ করে অগ্রসর হই। শ্রীনগর গ্রামের শেষ সীমানা, উত্তর প্রান্তে আমরা পৌছা মাত্রই পাক হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে পড়ি ও সাথে সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। এই যুদ্ধে তিনজন পাক সেনা ও পাঁচজন রাজকার নিহত হয়। ভাগ্যিস আমাদের মধ্যে কেহ হতাহত হয়নি। উক্ত যুদ্ধে রণ কৌশল হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের জয়নাল আবেদীন বিস্ফোরক দ্রব্যাদির মাধ্যমে টু ইঞ্চি ও ফোর ইঞ্চি মর্টারের সেলের বিকট শব্দ সৃষ্টি করে। এর ফলে পাক বাহিনী বুঝতে পারে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট ভারী অস্ত্র-সস্ত্র আছে, তাই তারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পাকবাহিনী পিছু হটে গেলে, আমরাও ভবানীপুর ফিরে এসে মসজিদের সামনে অবস্থান নিই। ঘন্টা দুয়েক পরে আশুগঞ্জ থেকে লঞ্চ যোগে পাক বাহিনী মেঘনা নদী দিয়ে ভৈরবের মেন্দীপুর ও মৌটুপীর দিকে আসছে। র্যাকির (গোয়েন্দা) মাধ্যমে এ খবর পেয়ে আমরা পিছু হটে রসুলপুর মসজিদের কাছে অবস্থান করি। ইতিমধ্যে পাক হানাদার বাহিনী শ্রীনগর গ্রামে ব্যাপক গুলি করতে করতে এবং শ্রীনগর গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পিছু হটলে ও লঞ্চ যোগে পাকবাহিনী নদী দিয়ে আসতে থাকায় তৎ সময়ে আমরা কিং কর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরি। এই রকম সংকটে আমরা ভাবতে থাকি “আমাদের মা-বাবা, আত্মীয় স্বজনকে পাক হানাদার বাহিনীর বুলেট ও বেয়নট এর সামনে ফেলে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাব? নাকি যুদ্ধ করে মরে যাব”। এলাকাবাসী আরোও বলে তোমরা যদি পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, তবে শ্রীনগরের মতো ভবানীপুর, রসুলপুর, সাদেকপুর, মৌটুপী ও মেন্দীপুর আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেবে এবং অনেককে গুলি করে মারবে। গ্রামবাসী ও মা-বাবার প্রবল অনুরোধে আমরা নৌকা যোগে কুলিয়ারচর চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। পরে জানতে পারি, এই অতর্কিত যুদ্ধের প্রতিশোধ হিসেবে পাক হানাদার বাহিনী শ্রীনগর গ্রামের পাচঁজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এই যুদ্ধে নিরীহ সাধারণ মানুষ যারা শহীদ হন তারা হলেন ১. আফসার উদ্দিন, ২. ফয়েজ মিয়া, উভয় পিতা- গাজী মাহমুদ, ৩. মুলেক হোসেন, ৪. ফালু মিয়া উভয় পিতা- ইসব আলী, ৫. ইসমাইল মিয়া, পিতা- মুছা মিয়া। আমরা কুলিয়ারচর পৌঁছে ঘাইলকাটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করি। ঐখানে ২দিন থাকার পর কুলিয়ারচর লক্ষীপুর গ্রামের একটি হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করি। পরবর্তীতে কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশন শক্রমুক্ত করার জন্য পুনরায় ভূঁইয়া বাহিনী ও গফুর বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে ত্রিমুখী আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করি এবং কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশন রাজাকার মুক্ত করি। এই উল্লাসে গ্রামবাসীগণ দা, কুড়াল, বটি দিয়ে কতক রাজাকারকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। রাজাকার কমান্ডার দুর্ধর্ষ শাহাবুদ্দিন ঐ দিন পাক বাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য ভৈরবে চলে আসার ফলে তাকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে পাক বাহিনী ভৈরব হইতে রেল যোগে কালিকাপ্রসাদ আসার পরিকল্পনা করছে, খবর পেয়ে আমরা পরদিনই ইঞ্জিনিয়ারিং কোর কমান্ডার মো: কামাল উদ্দিন ও জয়নাল আবেদীন এর নেতৃত্বে বিস্ফোরকের মাধ্যমে গাজীরটেকের রেল ব্রীজটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেই। এরপর থেকে পাক বাহিনী আর কোন দিন কালিকাপ্রসাদ অভিমুখে আসতে পারে নাই, ২৭শে অক্টোবর কালিকাপ্রসাদ রেলস্টেশন অপারেশনে ভূঁইয়া বাহিনীর কুমিল্লার বাসিন্দা হুমায়ুন কবির নামীয় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁকে ২৮শে অক্টোবর সকাল ৯ ঘটিকায় জানাযা শেষে কুলিয়ারচর থানার মাঠের কোনায় স্ব-সম্মানে দাফন করা হয়। তাহার কবর এখনও বিদ্যমান রয়েছে। তারপর আমাদের ক্যাম্প ভৈরবের গজারিয়া ধরবাড়িতে নিয়ে আসি। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাক সেনারা আত্মসমর্পন করলেও আমাদের ভৈরব শক্রমুক্ত হয়নি। ১৮ই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থানের খোঁজ-খবর নিয়ে আমরা হামিদ ভাই সহ কয়েকজন আগানগর, আজবপুর ও পানিশ্বর হয়ে আশুগঞ্জের উদ্দেশ্য রওয়ানা হই। ঐ দিনই আজবপুর মোতালিব বেপারীর বাড়িতে রাত্রি যাপন করি। ১৯শে ডিসেম্বর আশুগঞ্জ রেলস্টেশন ও সাইলো গোডাউনে অবস্থানরত ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ১৯ রেজিমেন্টের মেজর মেহেতার এর সাথে সাক্ষাত করে, ভৈরবে পাক বাহিনীর অবস্থান সমূহ বর্ণনা করি। তিনি তাৎক্ষনিক ভৈরবে এয়ার রেড করার জন্য নির্দেশ দেন, পরক্ষণে ভারতীয় দুটি জঙ্গী বিমান এসে ভৈরবের মেঘনার তীরে পাক বাহিনীর ব্যাংকারে ও লঞ্চে বোমা ফেলে। বোমার আঘাতে পাক বাহিনীর লঞ্চটি সম্পূর্ণরূপে ধবংস হয়ে যায়। এরপর মিত্র বাহিনী ভৈরব বাজারে প্রবেশ করে সমস্ত পাক সেনাকে ভৈরব রেলস্টেশন সংলগ্ন হাসপাতালে আটকে রাখে। মিত্র বাহিনীর ১৯ রেজিমেন্টের মেজর মেহেতার আমাদের কোম্পানী কমান্ডার এম.এ হামিদ সহ আমরা কতক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটি জীপ গাড়ী সহ একপ্লাটুন পাকসেনা নিয়ে ভৈরবপুর হাফিজ উদ্দিন মিয়ার বাড়ির উত্তরে ও পশ্চিমের মাঠের মাটির নিচ হইতে প্রচুর অস্ত্র-সস্ত্র মর্টার, কামান ও গোলাবারুদ পাক সেনাদের ব্যবহার করা ট্যাংক লরি ইত্যাদি উদ্ধার করে রেলওয়ে স্কুলে এনে জমা করি। ভৈরবে অবস্থানরত পাকসেনারা এভাবেই আত্মসর্মপন করতে বাধ্য হয় এবং ভৈরব শক্রমুক্ত করি। ঐ সময় আমাদের কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মিত্র বাহিনীর একটি জীপ চালাতে দেয়। উক্ত জীপের চালক ছিল কৃষি ব্যাংকের দারোয়ান আবদুল করিম। জীপ গাড়ীটি নিয়ে পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থান হইতে আমরা ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে অস্ত্র-সস্ত্র উদ্ধার পূর্বক যোগাযোগ রক্ষা করি। আমরা তখন ভৈরবপুর গার্লস স্কুলের সামনে হাজী হাফিজ উদ্দিন মিয়ার বাংলোতে ক্যাম্প স্থাপন করি ও অবস্থান নেয়। কয়েক দিনের মধ্যেই ভৈরবে আটকে পড়া পাকসেনাদেরকে রেললাইনের রাস্তা দিয়ে মিত্র বাহিনী ঢাকা নিয়ে যান। আমরা বেশ কিছু দিন ভৈরবপুর হাজী হাফিজ উদ্দিন মিয়ার বাড়িতে থাকার পর কোম্পানী কমান্ডার এম.এ হামিদের নির্দেশে সঙ্গীয় সকল মুক্তিযোদ্ধাগণ ভৈরব বাজার লঞ্চঘাট হইতে একটি লঞ্চযোগে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে চামড়াঘাট নদীর তীরবর্তী স্থানে নেমে উদ্ধারকৃত অস্ত্র-সস্ত্র কাঁদে করে হেঁটে হেঁটে কিশোরগঞ্জ মহকুমা সদরে পৌঁছে এসডিও অফিসে যার যার বরাদ্ধকৃত ও উদ্ধারকৃত অস্ত্র জমা করি। বেশ কিছুদিন মহকুমা সদর ক্যাম্পে ম্যালেশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে বলে মেজর মতিউর রহমানের তত্ত্বাবধানে থাকার পর আমরা মুক্তিযোদ্ধাগণ কর্ণেল এমএজি ওসমানী স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ হাতে নিয়ে দীর্ঘপথ পুনরায় পায়ে হেঁটে যার যার বাড়িতে চলে আসি। প্রায় আটচল্লিশ বছর পেরিয়ে যাওযায় সকল কিছু অবতারণা করতে পারি নাই।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তোফাজ্জল হক,
সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, ভৈরব উপজেলা কমান্ড,
সাবেক চেয়ারম্যান, সাদেকপুর ইউনিয়ন পরিষদ,
ভৈরব, কিশোরগঞ্জ।