মোঃ ছাবির উদ্দিন রাজু বিশেষ প্রতিনিধিঃ
দেশ বিদেশে এবং কালে কালে এমন কিছু মানুষের আবির্ভাব হয় যাঁরা সাধারণ মানুষকে ভালোবেসে নিজের জীবনকেই উৎসর্গ করে একসময় নিজেরাই হয়ে ওঠেন বরেণ্য ও বিখ্যাত। এসব বরেণ্য ব্যক্তিদের অসীম ত্যাগ, নিরলস পরিশ্রম, পাণ্ডিত্য, মাটি-মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও আদর্শ সকলের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে অহর্নিশ জ্বলজ্বল করে। তাঁদেরই একজন ভৈরবের কৃতী ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক, লেখক ও মনীষী রেবতী মোহন বর্মন।
লেখক রেবতী মোহন বর্মন ভৈরবের শিমুলকান্দি গ্রামে ১৯০৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরনাথ বর্মন ও মাতা রুক্ষিনী দেবী। পিতা ছিলেন তৎকালে একজন প্রসিদ্ধ আইনজীবী এবং বিশিষ্ট তালুকদার। একসময় ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাকে ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত করে।
পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান রেবতী মোহন বর্মনের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল পারিবারিক পরিবেশে। পরে তাঁকে ভর্তি করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সরাইল থানার চুন্টা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং পরে ঢাকার পগোজ স্কুলে। পগোজ স্কুলে পড়ার সময় তিনি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন।
রাজনীতির অভিযোগে তাঁকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হলে তিনি চলে যান কুমিল্লা জিলা স্কুলে। পগোজ ছাড়লেও রাজনীতি তাঁকে ছাড়েনি। কারণ মানুষে মানুষে বৈষম্য, দেশ শাসনের নামে সীমাহীন শোষণ এবং পরাধীনতার গ্লানি তাঁকে ভীষণভাবে পীড়া দিতে শুরু করেছিল।
একসময় তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা না দিয়েই মাহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন ও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। তিনি চাঁদপুরে চা-বাগানের শ্রমিকদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন এবং আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলেন। এজন্যে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিনি কিছুদিন কারাভোগ করেন।
তবে একসময় সেই আন্দোলনে ভাটা পড়লে তিনি নিজ মহকুমায় চলে আসেন ও কিশোরগঞ্জ শহরের আজিমউদ্দিন স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ও মেধাবী ছাত্র। সেজন্যে স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছেও তিনি ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত।
আজিমউদ্দিন হাই স্কুল থেকে তিনি ১৯২২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সমগ্র আসাম-বেঙ্গলে প্রথম স্থান অধিকার করে সকলের মুখ উজ্জ্বল করেন। এ সময় তিনি ঢাকার শ্রীসংঘেও যোগদান করেন। শ্রীসংঘের সদস্য হিসেবে তিনি কলিকাতা, বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলায় কার্যক্রমের দায়িত্ব লাভ করেন।
নানা বৈপ্লবিক কর্মব্যস্ততার ভিতর দিয়েও তিনি বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ, সেন্ট পলস কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯২৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে এমএ পরীক্ষায়ও কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
সাহিত্যিক রেবতী মোহন বর্মন বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই ছিলেন পারদর্শী। তিনি ছিলেন একজন সুলেখক। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘তরুণ রুশ’ ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর সম্পাদনায় ‘বেনু’ নামে একটি মাসিক বেশ কিছুদিন প্রকাশিত হয়েছিল। এ মাসিকটি প্রকাশের অর্থ তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত স্বর্ণপদকটি বন্ধক রেখে জোগাড় করেন। পত্রিকাটি ছিল মূলত তরুণ বিপ্লবীদের জন্য। সরকার অবশেষে পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত ও বন্ধ করে দেয়।
ঢাকা থেকে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় সহজবোধ্য মার্কসবাদবিষয়ক ‘গণশিক্ষা সিরিজ’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেন। মাকর্সবাদের জনক কার্ল মার্কস-এর ‘দাস ক্যাপিটাল’-এর বঙ্গানুবাদ ‘ক্যাপিটাল’ তিনিই প্রথম প্রকাশ করেন। এছাড়া তাঁর উদ্যোগে ভারতে মার্কসবাদীদের নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ গড়ে তোলা হয়। ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ’ রেবতী মোহন বর্মনের শেষ লেখা গ্রন্থ যা তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ২৮টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর লেখা অন্য গ্রন্থগুলো হলো, ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’ (১৯৩৮), ‘মার্কস প্রবেশিকা’ (১৯৩৮), ‘কৃষক ও জমিদার’ (১৯৩৮), ‘সাম্রাজ্যবাদের সংকট’ (১৯৩৮), ‘হেগেল ও মার্কস’ (১৯৩৮), ‘ক্যাপিটাল’ (বাংলায় সংক্ষিপ্তসার, ১৯৩৮), ‘ভারতে কৃষকের সংগ্রাম ও আন্দোলন’ (১৯৩৮), ‘লেনিন ও বলশেভিক পার্টি’ (১৯৩৯), ‘Society and its Development’ (১৯৩৯), ‘Marxist View of Capital’ (১৯৩৯), ‘সমাজের বিকাশ’ (১৯৩৯), ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ (১৯৪৪), ‘শান্তিকামী সোভিয়েত’ (১৯৪৫), ‘অর্থনীতির গোড়ার কথা’ (১৯৪৫), ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ (বঙ্গানুবাদ), ‘সমাজতন্ত্রবাদ- বৈজ্ঞানিক ও কাল্পনিক’ (বঙ্গনুবাদ)।
রাজনীতির কারণে তিনি বার বার কারাগারে গেছেন এবং বিনা বিচারে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। কারাভ্যন্তরেও তিনি মার্কসবাদের প্রচার ও প্রসারে কাজ করতেন। তিনি জেলে বন্দিদের মার্কসবাদ বিষয়ে ক্লাস নিতেন। কারাবন্দিদের শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস এবং শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্বের কারণসমূহ বর্ণনা করে মুক্তির বিপ্লবী শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করতেন।
শোষকের কোনো জাত-ধর্ম অথবা দেশ-কাল নেই। তারা কালে কালে, দেশে দেশে বিভিন্ন কৌশলে লুণ্ঠন, নির্যাতন ও শোষণ করে। তারা এক ও অভিন্ন, তারা দেশের আপামর জনতার শত্রু। এই শত্রুদের হাত থেকে দেশ ও জনগণকে মুক্ত করে শোষণমুক্ত রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। অত্যাচার, নির্যাতন, কারাভোগ এমনকি কোনো প্রলোভনই তাঁকে আদর্শচ্যুত করতে সক্ষম হয়নি। আজীবন তিনি মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। দেশ ও জনগণের রাজনীতিই ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান ও সাধনা। এটাই তিনি সকল সুখস্বপ্ন ত্যাগ করে চরম আত্মত্যাগ ও কর্মের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, এ বিপ্লবী নেতাকে আটক করে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি শেষে বন্দি ছিলেন রাজপুতনার দেউল বন্দিশিবিরে। ব্রিটিশরা জেলখানায় তাঁর শরীরে কুষ্ঠরোগের জীবাণু প্রবেশ করিয়েছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। শেষ জীবনে তিনি আগরতলায় ছিলেন। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে এই খ্যাতিমান সূর্যসন্তান ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান।