Featured জাতীয়

ভারত গমণ ও প্রশিক্ষণে একজন মুক্তিযোদ্ধা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বর হত্যাকান্ড, নারী ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও মানবতা লঙ্গনকারী, রক্ত পিপাষু, হায়েনা পাক হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরতরে উৎখাতের জন্য ও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে আমাদের এলাকার যুবকদেরকে সংগঠিত করি। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য রাতের অন্ধকারে পিতা-মাতার অঘোচরে-অজান্তে সম্ভাব্য জুন-জুলাই মাসে, মৌটুপী গ্রামের আমি তোফাজ্জুল হক, আমার চাচাতো ভাই হামিদুল হক, মনোহরপুর গ্রামের আসমত আলী, রসুলপুর গ্রামের ফিরুজুর রহমান, খালেকুজ্জামান, এম এ হামিদ, জামালপুর গ্রামের আঃ সাত্তার, কালিকাপ্রসাদ গ্রামের রিয়াজ উদ্দিন, কামাল উদ্দিন, রহমত উল্লাহ, শ্রীনগর গ্রামের আলাল উদ্দিন, আঃ মতিন, জালাল উদ্দিনসহ আরো অনেকে মৌটুপী গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার সুঠাম দেহের অধিকারী মাঝি সুরুজ আলী (বর্তমানে মৃত) ও তার সঙ্গীসহ নৌকাযোগে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই।

একটি কথা না বললেই নয় যাওয়ার প্রাক্কালে কেহ যাহাতে খোঁজ খবর না জানতে পারে এবং তৎসময়ে আমার দাদা মৌঃ ওয়াছিল উদ্দিন ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তার আপন মেয়ের ঘরের আদরের নাতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন (বাদল) বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি ও তাহার ফুফাত ভাই মৌটুপীর সেরবাজ গ্রামের মোঃ আশরাফুল হক (মুকুল) মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমি এবং আমার চাচাতো ভাই হামিদুল হকের পিছু নেয় কিন্তু তাদের বয়স আমাদের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় কোন এক ফাঁঁকে তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে সুরুজ আলী মাঝির বাড়ির ঘাটে বাধা নৌকাটির পাটাতনের নিচে নৌকা ছাড়ার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত আমরা লুকিয়ে থাকি। ফলে তাহারা আমাদের সঙ্গী হতে না পেরে অনেক কষ্ট পায়।

প্রেসিডেন্ট দাদার ভয়ে এই লুকোচুরি করতে হয়েছিল। নিকটবর্তী ভারতের আগরতলা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া তৎসময়ে সরাইল বিশ্বরোডে পাক হানাদার ও রাজাকারদের নজরদারী বৃদ্ধি হওয়ায় ও রাস্তাটি ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় ঐ অঞ্চলে না যেয়ে অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ৩ (তিন) দিন নৌকা চলন্ত অবস্থায় অবস্থান করি। তৎসময়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকার প্রচলন ছিল না। ইঞ্জিনবিহীন নৌকায় বৈঠা, দাড় ও পাল তুলে অবশেষে সীমান্ত এলাকা মহেশখলায় মাঝি সুরুজ আলীর শশুড় বাড়িতে রাত্রি যাপন করি।

পরদিন সকাল ৯ ঘটিকায় সীমান্ত সংলগ্ন মহেশখলায় ফরেষ্ট অফিসে রিক্রুটিং ক্যাম্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেকান্দার আলী নূরী সাহেবের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মৌখিক সাক্ষাৎকার শেষে উত্তীর্ণ হয়ে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেশখলায় ইয়ুথ ক্যাম্পে বেশ কিছুদিন অবস্থান করি। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেশখলায় পাহাড়ের পাদদেশে ইয়ুথ ক্যাম্পে চীনা জোঁকের আক্রমনকে তোয়াক্কা না করে খিচুরী ও জঙ্গলী ডালসহ নিম্ন মানের খাবার খেয়ে কোন রকম দিনাতিপাত করি। কয়েকদিন পর মহেশখলা থেকে হেঁটে মহাদেব হয়ে লংড়া ক্যাম্পে অবস্থান করি। অল্প কিছু দিন পর পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বাঘমারা ক্যাম্পে অবস্থান করতে হয়। পায়ে হেঁটে প্রায় ৫০ মাইল এই পাহাড়ী দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বাঘমারায় পৌঁছাতে হয়। বাঘমারা হইতে ট্রাক যোগে মেঘালয় রাজ্যের তুরা পাহাড়ের পাদদেশে ১১নং ট্রেনিং সেন্টার তুরায় সন্ধ্যার পর পৌঁছি।

যেহেতু সন্ধ্যায় ট্রেনিং ক্যাম্পে রিক্রুট করা হয় নাই সেহেতু আমাদেরকে গেইটে অবস্থান করিতে হয়। হঠাৎ দেখিতে পাই, আমাদের পূর্বে আসা ভৈরবের চাঁনপুর গ্রামের এ.কে.আর হাবিবুল বাহার, সে স্কোয়ার্ড কমান্ডার হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকায়, তাহার সহযোগিতায় রাতেই ট্রেনিং ক্যাম্পের ভিতরে প্রবেশ করি এবং পরিশ্রান্ত শরীরে মাটিতে শুয়ে থেকেই বিশ্রাম নেই। দীর্ঘ একমাস তুরায় ট্রেনিং শেষে ২০৫ জন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত আমাদের রসুলপুর গ্রামের হিন্দী ভাষায় পারদর্শী এম.এ. হামিদকে কোম্পানীর কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানী গঠন করা হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় “দি মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স”। সকলেই মেঘনা পাড়ের ছেলে বলে “দি মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স” নামকরণ করা হয়। এস.এম.জি, রাইফেল, এল.এম.জি, এস.এল.আর সহ অন্যান্য অস্ত্রের সাথে আমাদের কোম্পানীতে রকেট রেঞ্জারও দেওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, ট্রেনিং শেষে ইন্ডিয়ান ওস্তাদগণ আমাকে পছন্দ করে আমার নামে এল.এম.জি অস্ত্র বরাদ্দ করেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে এল.এম.জিটি আমার চেয়ে বড় ও ভারি হওয়ায় এবং অন্যদের চেয়ে বয়সে আমি অনেক ছোট হওয়ায় আমার কান্নাকাটিতে এল.এম.জি অস্ত্রটি আমাদের কোম্পনীর প্লাটুন কমান্ডার ইটনার আঃ সাত্তার ভাইকে পুন:বরাদ্দ করে, তাঁহার বরাদ্দকৃত এস.এম.জি (স্ট্যানগান) আমাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। যাহার নাম্বার ছিল জেড-৫১৩৮।

উল্লেখ্য ট্রেনিং চলাকালীন কোন এক সময়ে ফায়ার করে লক্ষ্যবিন্দু (টিক্কা খানের মূর্তি) গুলিবিদ্ধ করতে না পারার কারনে আমাকে ভারতীয় ওস্তাদ আমার গালে সজোরে চপেটাঘাত করে। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বার লক্ষ্যবিন্দুতে ফায়ার করতে সক্ষম হই। ওস্তাদের চপেটাঘাতের এই স্মৃতির কথা আজও ভুলতে পারিনি। ট্রেনিং শেষে ভাগ্যক্রমে দৈবাৎ উপস্থিত হন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানী, ফলে তিনিই আমাদের শপথ বাক্য পাঠ করান। ১১নং সেক্টর এর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের। এরই মধ্যে একদিন খবর এলো আমাদেরকে বাংলাদেশের ভিতরে গিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলায় কাজ করতে হবে। সে খবর পেয়ে কি যে খুশি হয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়ে প্রথমে ঢালু পরে লংড়া ক্যাম্প হইতে মহেশখলায় এসে কোম্পানী কমান্ডার হযরত আলীর কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাক্ষাত হয়। আমরা মহেশখলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় উক্ত কোম্পানীর ভৈরব এলাকার চাঁনপুর গ্রামের এ.কে.আর হাবিবুল বাহার, শ্রীনগর গ্রামের নাজিম উদ্দিন, রাজাকাটা গ্রামের ইসলাম উদ্দিন, চন্ডিবের গ্রামের আব্দুর রহমান রতন, রসুলপুর গ্রামের এম.এ শহিদ (মৃত), সৈয়দ হাবিবুর রহমান, জয়নাল আবেদীন (মৃত), একে মাইন উদ্দিন, মহি উদ্দিন, শাজাহান কবির ও কালিকাপ্রসাদের বাচ্চু মিয়া ও সিরাজ উদ্দিন (মৃত) সহ বিভিন্ন গ্রুপ হইতে প্রায় ৪১ জন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে অর্থাৎ এম.এ হামিদ কোম্পানীর নেতৃত্বে মেঘনা রিভার অপারেশন ফোর্স এ একীভূত হই। এতে আমাদের কোম্পানীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৫ জন। সীমান্তবর্তী মহেশখলা ক্যাম্প হইতে ২টি বড় নৌকা ও ৫টি মাঝারি নৌকা নিয়ে আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রওয়ানা হই। ইঞ্জিন বিহীন নৌকাগুলি আনুমানিক ০৫ ঘন্টা বৈঠা দ্বারা ও পালের মাধ্যমে চলন্ত অবস্থায় হঠাৎ আমি যে নৌকায় ছিলাম রাত্রি ০৯ টার সময় এক অচেনা অজানা জায়গায় পানির নিচে থাকা টিলাতে ঘষা লেগে ফাটলধরে নৌকাতে পানি উঠতে থাকে। ফলে আমরা যার যার অস্ত্র উচিয়ে সাতরাতে থাকি। এতে আমরা প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অন্ধকারাচ্ছন্নে হতভম্ব হয়েপড়ি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমরা পার্শ্বে অবস্থিত গ্রাম মনে করে অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে ডাঙ্গাতে উঠি এবং দেখিতে পাই ইহা আনুমানিক এক হাজার বর্গ মিটারের একটি কবরস্থান। পরে জানা যায় ইহা ঘাটুয়া গোরস্থান, উপায়ন্তর না দেখে শেষবধি আমাদেরকে উক্ত কবরস্থানে মাথার উপরে পলিথিন টাঙিয়ে রাত্রি যাপন করতে হয়। সকালে ওঠে পার্শ্ববর্তী গ্রামের বিভিন্ন জনের সহায়তায় ছোট ছোট নৌকা দিয়ে পারাপার হয়ে পাশের গ্রামে এসে জানা যায় ইহা নেত্রকোনা জেলার পাঁচহাট গ্রাম। পরে উক্ত গ্রামের ইউনিয়ন কাউন্সিলে আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নেই।

পরদিন ইউনিয়ন কাউন্সিল মাঠে আমরা “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” জাতীয় সংগীতটি পরিবেশন করি এবং নিকটবর্তী মসজিদে বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধারা শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করি। দুই দিন অবস্থান করে আমরা ইটনা থানার জয়সিদ্দি গ্রামে পৌঁছি। জানতে পারি ইটনা থানা সদরে কোন পাকিস্তানী সৈন্য নেই। একমাত্র রাজাকাররাই অবস্থান করিতেছে। সেখানে বসেই ইটনা থানা শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা করি। ইটনার দেওয়ান বাড়ির জনৈক দেওয়ান সাহেবের সক্রিয় সহযোগিতায় ও পরামর্শে ইটনা আক্রমন না করে অভিনব কায়দায় প্রায় তিনশত রাজাকারকে আত্মসমর্পন করিয়ে ইটনাকে শত্রুমুক্ত ঘোষনা করি এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-সস্ত্র জব্দ করি। ইটনাকে শত্রুমুক্ত বজায় রাখার জন্য সহকারী কোম্পানী কমান্ডার ইটনার সালাউদ্দিন, প্লাটুন কমান্ডার আব্দুস সাত্তার, মামুন, আনোয়ার, কামালসহ তৎ এলাকার বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ইটনা অবস্থান করার জন্য রেখে, আমরা মিঠামইন থানার ঢাকী গ্রামে এসে অবস্থান নেয়। পরদিন আমরা মিঠামইন ত্যাগ করে অষ্টগ্রাম অভিমূখে রওয়ানা হই। প্লাটুন কমান্ডার ফিরুজুর রহমান (পরবর্তীতে উপসচিব) এবং আর্টিলারি আর্মিম্যান রকেট রেঞ্জার চালক ফজলুর রহমানের তত্ত্বাবধানে তৎ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অষ্টগ্রামের দায়িত্ব অর্পন করে ও সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধা সোহরাবকে নিকলীর দায়িত্ব অর্পন করে আমরা নিজ এলাকা ভৈরবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ( চলবে) পর্ব ০২।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তোফাজ্জল হক, সাবেক চেয়ারম্যান, সাদেকপুর ইউনিয়ন পরিষদ ও সাবেক ডেপুটি কমান্ডার, ভৈরব উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ।
মোবাইল: ০১৭১১-৪৮৯০৬৭ *********

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *