লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি : ‘‘নদীতে মাছ ধরে যে টাকা পাই, তা দিয়া সংসারের খাওন জোটে না। আবার নতুন জামা-কাপড়, কোরমা, পোলাও? এগুলা দিয়া কী অইবো? আমাগো ঈদ কাটে নদীতে মাছ ধরার মধ্য দিয়ে। আমাগো আনন্দ সংসারের খাওন জুটানো আর মহাজনের দেনা পরিশোধে।’’
এভাবে নিজের কষ্টের কথা বললেন লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট এলাকার ভাসমান জেলে পারভীর আক্তার। তিনি জন্মের পর থেকে বাবার এবং বিয়ের পর স্বামীর নৌকায় থাকছেন। বর্তমানে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জননী তিনি।
তিনি বলেন, ‘‘নদীতে এহন আর আগের মতো মাছ ধরা হড়ে না। তাই সংসারে অনেক অভাব। ঈদের দিনও মাংস দিয়ে দুই বেলা পেট ভইরা ভাত খাইতে হারি না, পোলাপানেরে নতুন জামা-কাপড় লই দিতাম হারি না।’’
পারভীনের মতোই চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার মেঘনা নদী এলাকায় রয়েছেন অন্তত তিন হাজার ভাসমান জেলে। স্থানীয় ভাষায় যাদের বলে মানতা। নদী থেকে নদীতে বয়ে চলে তাদের নৌকা। মানতাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। তারা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বছরের পর বছর লড়াই করে পানিতে ভাসমান জীবনযাপন করছে।
চারিদিকে সবাই ঈদের আনন্দ উপভোগ করলেও ঈদ নেই মানতাদের। নদীতে মাছ ধরে যে টাকা পান, সেই টাকা মহাজনদের দেনা আর ডাল-ভাত জোগাতে শেষ হয়ে যায়। তাই পারছেন না ছেলে-মেয়েদের নতুন জামা দিতে। পারছেন না সেমাই, মাংস কিনে খেতে। তাদের ঈদ কাটে নদীতে মাছ ধরে।
সরেজমিন সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলে-মেয়ে আর পরিজন নিয়ে নৌকায় বসে আছে মানতারা। কেউ জাল বুনছে, কেউ জাল থেকে মাছ নিচ্ছে, আবার কেউ রান্না করছে। তাদের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। মানতাদের শিশু ছেলে-মেয়েরা নদীর পাড়ে খেলা করছে। আবার কেউ বাবা-মাকে সাহায্য করছে। তাদের শরীরে পুরাতন ছেঁড়া কাপড়।
মো. দুলাল হোসেন বলেন, ‘‘আমাগো বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি নেই, নৌকায় থাকি। ঈদে পোলাপানেরে জামা-কাপড় কিনে দিতে পারিনি। সরকার ও বিত্তশালীদের সহযোগিতা পাইনি। নদীতে মাছ পেলে খাবার জোটে, অন্যথায় না খেয়ে কাটে। আমাদের আবার কিসের ঈদ-আনন্দ?’’
শমজান বিবি বলেন, ‘‘সবাই নতুন জামা-কাপড় পিনবে, পোলাপানরে লইয়া আনন্দ কইরবো। আর আমরা পুরান জামা হরি নদীতে মাছ ধরেই আনন্দ করমু। ডাল আর ভাত খেয়ে কাটবে ঈদের দিন।’’
টাকা নেই। নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতে পারে না বাবা-মা। তাই পুরাতন জামা পরে কাটে তাদের ঈদ। তারা পায় না নামি-দামি খাবার খেতে। ঈদের আনন্দ বলতে এখানে আসা লোকদের নৌকায় করে নদীতে ঘুরানো, কিছু টাকা আয় করা। এমনই জানালো শিশু সাকিব হোসেন।
নদীর পাড়ে খেলা করছে শিশু আছমা, ইতি, বেলি ও শাহানাজ আক্তার। আলাপকালে তারা জানায়, ঈদ বলে তাদের বিশেষ কোনো দিন নেই। তাদের নতুন জামা-জুতা জোটে না। ঈদের দিন নৌকায় পোলাও মাংস রান্না হয় না।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর চর রমনী মোহন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ ছৈয়াল বলেন, মজুচৌধুরীরহাট এলাকায় মেঘনা নদীর তীরে তিন শতাধিক ভাসমান জেলে পরিবার রয়েছে। কয়েক দিন পূর্বে সরকারি বরাদ্দের কিছু চাল কয়েকজন জেলেকে দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ কম থাকায় তাদের সবাইকে সহযোগিতা করা যাচ্ছে না। সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানরা এগিয়ে এলে ভাসমান এ সব পরিবার কিছুটা আনন্দে ঈদ কাটাতে পারতো।
এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম মহিব উল্যা বলেন, অভিযানের (মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন) সময় জেলেদের জন্য চাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ সব ভাসমান জেলেদের জন্য ঈদের সময় বরাদ্দ আসে না।