বিনোদন

একজনকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রে ঈদের আনন্দ একজনই ভোগ করছে

এ.আর. মুশফিক: ঈদে চলচ্চিত্র পাড়ায় বাড়তি আমেজ তৈরি হয়। প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পীদের মধ্যে এই আমেজ লক্ষ্য করা যায়। শুধু তাই নয়, সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের মধ্যে থাকে ঈদের সিনেমা নিয়ে আগ্রহ। সিনেমা হলগুলোও ঘষা-মাজা, রং করে ঝকঝকে করা হয়। সিনেমাপাড়া খ্যাত কাকরাইলেও যেন তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। তবে কালের বিবর্তনে সেই উৎসব এখন অনেকটাই ম্লান। ঈদের ঠিক দু’দিন আগেও বলা কঠিন কোন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। এখন আর ঈদের সিনেমা মুক্তির উৎসব কাকরাইলে চোখে পড়ে না। মনে হচ্ছে ঈদে সিনেমা মুক্তির প্রস্তুতির ধরনেও এসেছে পরিবর্তন।

চলচ্চিত্রের সেই সোনালী সময়ে ঈদের সিনেমা মানেই জনপ্রিয় শিল্পী, বেশি বাজেট, বেশি প্রচারণা, দর্শকদের বেশি আগ্রহ- সব কিছুই যেন একটু বেশি বেশি। এখন তা পরিবর্তন হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাশীল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের পেশীশক্তি আর ক্ষমতা প্রদর্শনে। ঈদের সিনেমা মুক্তির প্রস্তুতিতে কতটা পরিবর্তন এসেছে জানতে রাইজিংবিডির এই প্রতিবেদক কথা বলেন চলচ্চিত্র সংশ্লীষ্টদের সঙ্গে।

প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা সোহেল রানা। তিনি এক সময় চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি ও পরিচালক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সিদ্ধান্তে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা মুক্তি পেত। সে-সময় ঈদে সিনেমা মুক্তির প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় সিনেমা হল ছিলো এক হাজার ছয়শ। এখন সিনেমা হল তিনশ পঞ্চাশটি। তখন কোন হল কী সিনেমা নেবে, কয়টা সিনেমা মুক্তি পাবে এ নিয়ে গণ্ডগোল হতো। তখন এসব নিয়ে মিটিংয়ের পর মিটিং করতে হতো। একেক সময় একেক ভাবে সমস্যার সমাধান করতাম। এমনও হয়েছে টস করে সিনেমা মুক্তি দিয়েছি। একই সময়, একই শিল্পী, একই ধরনের সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে টস করতাম। এখন তো সিনেমা পাওয়াই মুশকিল। আমরা মাঝে মাঝে প্রযোজক সমিতি থেকে বলে দিতাম, চারটা সিনেমার বেশি মুক্তি দেয়া যাবে না। আবার কেউ কেউ এটা মানতে চাইত না। এ নিয়ে আমরা বিচারে বসতাম। কিন্তু এখন এসব উঠে গেছে। এখন যেমন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ঈদি চাওয়া উঠে গেছে, তেমন এখন ফিল্মের চাওয়াটাও উঠে গেছে। এখন গরু কত দিয়ে আনা হয়েছে? কার গরু কেমন- এসব নিয়ে আলোচনা হয়। আমাদের সময় হলে কোন সিনেমা যাচ্ছে? কোনটা কেমন সিনেমা- এ নিয়ে আলোচনা হতো। তাছাড়া এখন যে সিনেমাগুলো মুক্তি পাচ্ছে কোনটা বাংলাদেশের, কোনটা ইন্ডিয়ার বোঝা মুশকিল।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার ছটকু আহমেদ। ঈদের সিনেমা মুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অতীতে চলচ্চিত্রের ঈদ ছিলো সার্বজনীন আনন্দ। এখন চলচ্চিত্রের ঈদ একজনকেন্দ্রিক আনন্দে রূপান্তরিত হয়েছে। অতীতে ঈদের সময় ফিল্ম পাড়ার প্রতিটি অফিসে ছিলো চলচ্চিত্র পরিবারের উপচে পড়া ভিড়। প্রযোজক অফিসে বসে পরিচালকের দেয়া পেমেন্ট লিস্ট দেখে প্রডাকশান বয় থেকে শুরু করে প্রডাকশান ম্যানেজার, লাইটম্যান, মেকআপম্যান, ক্যামেরাম্যান, বিভিন্ন সহকারী, মিউজিক ডিরেক্টর, শিল্প নির্দেশক, শিল্পী সবাইকে টাকা দিতো। বুকিং এজেন্টরা অফিসে অফিসে টাকার বান্ডিল নিয়ে এসে নিজ নিজ হলের জন্যে ছবি বুক করতো। অফিস ম্যানেজার বুকিং করার ফুরসত পেতো না, পিয়নরা এইট সিটার, ফোর সিটার, টু সিটার, ২ থেকে ৩ রকম সিঙ্গেল সিটার পোস্টার ভাঁজ করতো হলে দেবার জন্যে। হল প্রতিনিধিরা ঘুরঘুর করতো অফিস থেকে অফিসে প্রিন্টের সাথে হলে হলে যাবার জন্যে। আমরা রাত জেগে এফডিসিতে গ্রেডিং করেছি। প্রিন্ট চেক করেছি, প্যাচ প্রিন্ট করেছি। চেক করা প্রিন্ট ক্যানে ভরে লেভেলিং করেছি। এফডিসি থেকে শুরু করে ফিল্ম পাড়া পর্যন্ত উৎসবের ধুম পড়ে যেতো। এখন ঈদ হচ্ছে এক অফিসকেন্দ্রিক। একটা অফিসজুড়ে ঈদের সব আনন্দ। একাই একজন ঈদ করছে। পকেটে বৈধ-অবৈধ টাকা ভরছে। একজনকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রে ঈদের আনন্দ একজনই ভোগ করছে। যে এফডিসিতে রাত জেগে জেগে ঈদের প্রিন্ট হতো এখন সেই এফডিসি নিষ্প্রভ। অফিসগুলো সব অন্ধকারে নিমজ্জিত। ঈদের আনন্দ আর সার্বজনীন নেই।’

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ও মধুমিতা সিনেমা হলের স্বত্ত্বাধিকারী ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ। দীর্ঘদিন তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত। সিনেমা মুক্তির প্রস্তুতি প্রসঙ্গে নওশাদ বলেন, ‘সিনেমার বাজার যখন ভালো ছিলো তখন ঈদের সিনেমার সেন্সর হতো এক মাস আগে। এক মাস আগেই আমরা জানতে পারতাম কোন সিনেমা ঈদে মুক্তি পাচ্ছে। এর মধ্যে পছন্দ অনুযায়ী হলে সিনেমা নেয়া হতো। এক মাস আগে থেকেই সিনেমা হলে ট্রেইলার, পোস্টার সাঁটানো হতো। দর্শক খুব সহজেই জানতো ঈদের সিনেমার নাম। এখন ঈদের আগের দিনও বলতে পারছি না, কোন কোন সিনেমা ঈদে মুক্তি পাচ্ছে। ঈদের দুদিন আগে সিনেমার সেন্সর করা হয়। ফলে আমরা হল মালিকগণ সিনেমার প্রচারণা করতে পারছি না। সিনেমা মুক্তির প্রস্তুতিও নিতে পারছি না। শেষ মুহূর্তে এসে তড়িঘড়ি করেই সিনেমা মুক্তি দিতে হচ্ছে। আর একটা বিষয় এখন বেশি হচ্ছে ক্ষমতার ব্যবহার। আগে সিনেমা মুক্তি নিয়ে এখনকার মত ক্ষমতার ব্যবহার করা হতো না। প্রযোজক সমিতি না থাকায় এসব হচ্ছে। আগে কোরবানির ঈদে অ্যাকশন সিনেমা মুক্তি দেয়া হতো। এখন সে বিষয়টিও উঠে গেছে। এখন অ্যাকশন সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা রোমান্টিক-অ্যাকশন।’

‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ খ্যাত নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান। তার হাত ধরে চলচ্চিত্রে এসেছেন সালমান শাহ, শাকিল খান, শাকিব খান, মৌসুমীসহ অনেকে। ঈদের সিনেমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে সাধারণত রোজার ঈদে রোমান্টিক ঘরানার সিনেমা মুক্তি দেয়া হতো।আর কোরবানির ঈদে অ্যাকশন। তবে এখন এসব বিষয় কেউ মানছেন না। ইচ্ছে মতো সিনেমা মুক্তি দিচ্ছেন। তাই এখন আর সিনেমা মুক্তির জন্য প্রস্তুতিও তেমন নিতে হয় না। নিজেদের ইচ্ছে মতো সব কিছু করা হয়। আগে ঈদে সিনেমা মুক্তির জন্য মাসখানেক আগেই প্রস্তুতি নিত প্রযোজক, হল মালিক, পরিচালক। এমনকি শিল্পীরা সিনেমা মুক্তির জন্য আগে থেকেই প্রচারণায় নেমে যেত।’

জনপ্রিয় খল অভিনেতা মিশা সওদাগর। তিনি আশির দশক থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে আসছেন। এখন তার অভিনীত সর্বাধিকসংখ্যক সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ঈদের সিনেমার মুক্তির প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন সবাই ঈদে সিনেমা মুক্তি দিতে চাচ্ছে। তখনকার একটা সিনেমায় রাজ্জাক ভাই, আলমগীর ভাই, শাবানা আপার সঙ্গে সালমান শাহ-মৌসুমী থাকতো। তখন এদের সবার উপরে গল্প ছিলো। তাই দায়িত্বটাও সবার ছিলো। আর এখন সিনেমা হয় নায়ক-নায়িকা আর ভিলেনের উপর। তাই দায়িত্বটা ভাগ হয়ে কমে গেছে। তখনকার সময় বড় প্রোডাকশন, বড় নির্মাতা, বিগ কাস্টিংয়ের সিনেমা হতো। তখন বড় প্রোডাকশন ছাড়া কেউ ঈদে আসার সাহস করতো না। তখন সিনেমা চলতো। মান্না-মৌসুমীকে নেয়ার পরে ওদের বাবা-মা নেয়া হতো শাবানা-আলমগীর। এরপর হুমায়ুন ফরীদি ভাই মিশা সওদাগরকে নেয়া হতো ভিলেন হিসেবে। আবার কমেডির জন্য নেয়া হতো দিলদার-নাসরিনকে। এখন সিনেমায় কমেডি নেই। সারাক্ষণ নায়ক-নায়িকা দেখবে মানুষ? এখন সিনেমায় গান তেমন হিট হয় না। বাংলা সিনেমা পরে যাওয়ার পিছনে গান অন্যতম। বাংলা সিনেমায় গানই তো প্রাণ।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *